দেবতনয়া

 ** দেবতনয়া ( প্রথম পর্ব) **

** অলোকা চক্রবর্তী **


আমি পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকায় বাড়ির লোকজনের তাগিদা থাকলেও বিয়ে করেছিলাম আমাদের সময়ে একটু বেশি বয়েসে।  বিয়ের বছর তিনেক পর আমার একটি কন্যা সন্তান হয়। 

      ছোট্ট বয়েস থেকে ওর প্রতি স্নেহের আধিক্য ছিল আমার বেশী। তিন ক্রোশ দূরে একটি স্কুলে পড়াতাম আমি তবে পয়সার জন্য নয় আমার শিক্ষাদান করতে ভালো লাগতো বলে। তখন পাঠশালা আর কয়েকটি গ্রাম  দূরে একটা স্কুল । আমার মামাবাড়ি কলকাতায় বলে সেখানে থেকে পড়াশোনার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। 

      পড়ানো ছাড়া  বাবার জমিদারির কিছু হিসেব নিকেশ দেখতে হতো আমাকে বাবার আদেশে। 

       এতো কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও আমি সুযোগ পেলেই আমার মেয়ে বিন্দুর মুখটা দেখে আসতাম। ওর হাসি আমাকে টেনে আনতো বারবার অন্দরমহলে।

        মা হেসে বলতেন দেব কিছুক্ষণ অন্তর মেয়ের মুখ না দেখলে হাঁফিয়ে উঠে। জ্যাঠাইমা বলতেন দেব নারায়ন !  মেয়ে মানুষের জন্ম হয় রে পরের বাড়িতে যাবার জন্য এতো মায়ায় নিজেকে বাঁধিস না কষ্ট পাবি।

         আমার সেই বিন্দু আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এমন মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ নেই। মেয়ে মানেই হাজার নিয়মের বেড়া , আমার বিন্দুর অদম্য শেখার ইচ্ছে,জানার ইচ্ছে জগতকে।

       কিন্তু সবাই তাকে মেয়ে হয়ে জন্মেছিস এটায় বারবার বলে। সবাই ওকে বোঝায় মেয়েদের অত কৌতুহল থাকা ভালো নয়। মেয়েদের জ্ঞান হেঁসেল আর পূজো অর্চনায় সীমাবদ্ধ থাকায় উচিত নইলে সংসারে অনর্থ ঘটায়।

        বিন্দুর আশ্রয় স্থল ছিলাম আমি, আমার কাছে ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারতো। আমি ওকে আমার যতটুকু জ্ঞান সবটুকু দিয়ে তিলতিল করে ওকে সবার থেকে আলাদা মানসিকতায় মানুষ করতে চেয়েছিলাম।

        আমি বিন্দুকে ছোট থেকে শুনিয়েছিলাম ভারতবর্ষের ইতিহাসের সেই বীর মেয়েদের গল্প যাঁরা সমাজে, দেশে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে লড়াই করেছে। । হয়তো আমি চেয়েছিলাম আমার মেয়ে স্বতন্ত্র মেয়ে হয়ে মাথা তুলে থাকুক সংসারে। মেয়ে জন্মের গ্লানি যেন ওকে না স্পর্শ করে।

        বিন্দুর দশবছর বয়েস থেকে আমার মা, কাকিমা জ্যাঠিমারা ওর বিয়ের জন্য আমাকে পীড়াপীড়ি শুরু করে ‌।  স্পষ্ট কথায় তাদের বুঝিয়েছিলাম আমার বিন্দুর জন্য আমি সংসার কেন সমাজের নিয়মও ভাঙ্গতে পারি।

        বিন্দুও বাবার মত স্পষ্টবাদী সবকিছুর সে প্রতিবাদ করে। তাঁর সমবয়সী সব ছেলেদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে মেয়ে বলে কিছুতেই হারবে না সে। আমি গর্ব অনুভব করি কিন্তু ভয়ও পাই ওর ভবিষ্যত ভেবে। সবাইকে কি ওকে বুঝবে ওর সরলতা ওর হার না মানার জেদ কে।

        অবশেষে বাড়ির বড়দের জোরাজুরিতে ঘটকের আনা সমন্ধে রাজি হলাম বিন্দুর বিয়ের জন্য। ছেলের বাড়ির লোকেরা এসেছেন বিন্দুকে দেখতে। ওনারা জলযোগ সারার পর  মেয়েকে দেখতে চাইলো। আমার বুকের ভিতর কান্না জমে উঠেছে বিন্দুকে পরের বাড়িতে পাঠাতে হবে ভেবে।

       আমার মা বিন্দুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন, একি আমার বিন্দু কবে এত বড় হয়ে গেল।গয়না আর মায়ের বেনারসীতে শাড়িতে এযে দূর্গা প্রতিমা মনে হচ্ছে। ছেলের বাড়ির লোক আজব সব প্রশ্ন করছে আমার চঞ্চল বিন্দু ধীর স্থীর হয়ে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে।

        এরপর ওনারা বিন্দুর চুল খুলে দাঁড়াতে বললো বিন্দু খানিকক্ষণ থমকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো অন্যায় আবদার,আর মেয়ে জন্মের হেনস্থার অভিযোগে জানাবার জন্য। ওর দৃষ্টির মধ্যে ছিল অসহায়তা,বাবার কাছে নালিশ।ভেবেছিল হয়তো ওর বাবা ওর ঢাল হবে মেয়ে দেখার নামে এই অন্যায় প্রহসন রুখবে।ওর বাবা অন্য সব দিনের মত এইদিনও ওর পাশে থাকবে।

        আমি বিন্দুর চোখে চোখ রাখতে পারলাম না মেয়ের বাবা হয়ে সমাজের নিয়মের কাছে হেরে গেলাম মাথা নিচু করে।

       ** ক্রমশঃ**


        

        

Comments

Popular posts from this blog

আমার স্বপ্নের ঘর

মল্লিকাঅর্জুন ( চতুর্থ পর্ব)

আমি সেই মেয়েটা