মল্লিকাঅর্জুন (শেষ পর্ব)
** মল্লিকাঅর্জুন ( শেষ পর্ব) **
** কলমে -- অলোকা চক্রবর্তী **
আমাদের বিয়ের ফাইনাল হয়ে যাবার পর আমি মল্লিকাদের বাড়িতে গিয়ে প্রস্তাব দিই আমাদের বিয়ের যাবতীয় খরচা আমি নিজে করতে চাই।
আমার প্রস্তাব শুনে ওর বড়দা বললেন অর্জুন তোমরা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছো ,নিজেদের পছন্দের মর্যাদা দিয়েছো ঠিক আছে। আমরাও তোমাদের পাশে আছি তাই বলে আমাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারিনা।
মল্লিকার বৌদি বললেন আমি ওকে মানুষ করেছি নিজের মেয়ের মতন । মেয়েটা ছোটবেলায় মা- বাবাকে হারিয়েছে তাই আমার চেষ্টা ছিল মায়ের অভাব পূর্ণ করা কতটা করতে পেরেছি জানি না। তবে মায়ের কর্তব্য তো শেষ হয়না, মা নিজে শান্তি পায় মেয়েকে মনের মত করে সাজিয়ে ছাতনাতলায় পাঠাতে পারলে। তুমি সেই সুযোগ আমাদের দেবে না।
আমার কেমন মনে হলো ওনারা বোধহয় আঘাত পেয়েছেন আমার কথায় সেইজন্য তাড়াতাড়ি কথা মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলাম। বেরিয়ে আসার সময় মল্লিকা আমাকে বলল আমি কড়ায় গন্ডায় ঠিক আদায় করে নেবো আমার যা দরকার ওই নিয়ে তুমি কিছু ভেবোনা। আমি হেসে ফেলি ওর কথা শুনে।
ওকে বলি আমি ভীষন খুশী হবো সেইদিন যেদিন সত্যি করে তুমি আমার কাছে কিছু দাবী করবে। মল্লিকা বলল তোমার তুমিটাই তো আমার হয়ে গেছো এর থেকে বড় উপহার আর কি হতে পারে। ওর উত্তর শুনে আমার খুব অহংকার হচ্ছিলো এমন সৌভাগ্যের অধিকারী হবার জন্য।
আমি কয়েকদিনের জন্য বাইরে গেছিলাম এসে শুনলাম মায়ের সঙ্গী হয়ে মল্লিকা মাকে বিয়ের কেনাকাটায় খুব সাহায্য করেছে। মা ওর পছন্দ অনুযায়ী ঘরের পর্দা থেকে বিয়ে বেনারসি সব কিনেছে।মা ভীষন খুশী মল্লিকার ব্যবহারে, মায়ের মুখে মল্লিকার প্রসংশা শুনে আমার ভীষন ভালো লাগছিল। ভগবানকে বারবার কৃতজ্ঞতা জানাই ওই রকম এক নারীর সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য হয়েছে বলে।
আর এক সপ্তাহ বাকি আমাদের বিয়ের , আজকে আমার জোড়াজুড়িতে মল্লিকা আসছে দেখা করতে। মল্লিকা আমাকে ইউনিভার্সিটির গেটের সামনে দাঁড়াতে বলেছে। ওর ইউনিভার্সিটিতে একটু কাজ আছে এই সুযোগে কাজটা সেরে নেবে ।
তখন দুটো বাজবে আমি মেডিক্যাল কলেজ পেরিয়ে ঠিক ইউনিভার্সিটির গেটের একটু আগে আবছা মনে হল মল্লিকা রাস্তার উপারে, কিন্তু হঠাৎ গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল চিৎকার চেঁচামেচি, আমি গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে?, একজন বললেন একটা মেয়েকে ট্রামে ধাক্কা দিয়েছে।
কথাটা শুনে আমার হাত,পা কেমন অসাড় হয়ে গেল। আমি গাড়িটাকে কোন রকমে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে ছুটলাম। কিন্তু সামনে গিয়ে দেখি আমার আশঙ্কায় সত্যি মল্লিকা রাস্তায় পরে আছে।রক্তে ভেসে যাচ্ছে তবু আমার দিকে হাতটা বাড়িয়ে খালি বলল অর্জু--ন ।
আমি কিছুক্ষন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরেছিলাম তারপর মনকে শক্ত করলাম আমার মল্লিকাকে আমি কিছুতেই হারাতে পারবোনা ওকে যে আমার ভীষন প্রয়োজন। আমি রক্তাক্ত মল্লিকাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে তুলে নিলাম,তারপর যতটা জোরে হাঁটতে পারি হেঁটে মেডিক্যাল কলেজের দিকে রওনা দিলাম। ওদিকে কিছু সাংবাদিক প্রশ্ন করে যাচ্ছেন 'অর্জুন মুখার্জি' ! ওনি আপনার পরিচিত?,কে হোন আপনার ?। উত্তর দেবার মত মানসিক অবস্থা ছিল না আমার।
মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারদের সহযোগিতায় খুব তাড়াতাড়ি ওর চিকিৎসা শুরু হলো। ওকে বেশ কয়েকবোতল রক্ত দিতে হয়েছিল এই ব্যাপারে মল্লিকার বন্ধুরা, ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টরা খুব সাহায্য করেছিল। আমি আমার যত উপরমহলের চেনাজানা আছে সব কাজে লাগালাম মল্লিকার দ্রুত ভালো চিকিৎসার জন্য। দিল্লি থেকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারেরা ,এখানকার ডাক্তারেরা মিলে স্পেশালঃ বোর্ড বসিয়ে ওর চিকিৎসা চলল।
যমে মানুষে টানাটানি হলো কয়েকদিন, আমার মা এবং মল্লিকার বাড়ির লোকজন সবাই আছেন। এই কদিন কখন সকাল হয়েছে, কখন রাত হয়েছে আমি জানি না। আমি কারুর সঙ্গে একটাও কথা বলিনি এই কদিন।
আমার গলার স্বর কেমন থমকে গেছিল ,যেদিন ডাক্তাররা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন অর্জুন বাবু অন্ততঃ সুখবর আপনার মিসেস এখন বিপদমুক্ত আর কোন ভয় নেই ওনার ।আমি ভুলে গেছিলাম আমি কে ডাক্তারের হাত ধরে প্রথমে অঝোরে কেঁদে ফেলেছিলাম। ডাক্তারবাবু দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম "সত্যি বলছেন তো ডাক্তারবাবু"।
ডাক্তারবাবু আমাকে বললেন আপনি নিজে দেশের একজন প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন সাংবাদিক, আপনি জীবনের কত ঝুঁকি নিয়ে খবর সংগ্রহ করেন সেই আপনি এত মনোবল হারিয়ে ফেলছেন। শক্ত হোন কোন ভয় নেই একটু পরে আই,সি,ইউ থেকে ওনাকে বের করে কেবিনে দেওয়া হবে আপনি গিয়ে দেখা করে আসবেন।
অবশেষে আমি মল্লিকার সামনে-- গলা জড়িয়ে আসছে কান্নায় ওর হাতটা ধরে চোখের জল লুকালাম। মল্লিকা আমার ছোঁয়া পেয়ে বলল আমার দিকে তাকাও দেখো আমি ভালো আছি তো। আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। আমি ওর মুখে হাত দিয়ে মাথা নাড়তে লাগলাম। সেই সময় মল্লিকার বৌদি ঢুকে বললেন মল্লিকাঅর্জুনের জুটি স্বয়ং ভগবান বানিয়েছেন।কার সাধ্য তাদের আলাদা করবে।
আমার মল্লিকা সুস্থ হবার একমাস পরে আমাদের বিয়ে সুসম্পন্ন হলো সেইটুকু নিয়ম মেনে যাতে মল্লিকার কোন কষ্ট না হয়। মল্লিকা এখন আমার বাগানে ফুটে আছে আলোকিত করে নিজের সৌরভে।
Comments
Post a Comment