মল্লিকাঅর্জুন (প্রথম পর্ব )

** মল্লিকাঅর্জুন ( প্রথম পর্ব) **

** কলমে-- অলোকা চক্রবর্তী **


 মল্লিকার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল একটা অনুষ্ঠানে যেখানে মল্লিকা সঞ্চলনা করছিল অনুষ্ঠানটির । সৌভাগ্যবশত সাংবাদিক জীবনে সেই প্রথম কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নিউজ কভার করতে গেছিলাম। যদিও কলকাতার নামকরা ক্লাবের অনুষ্ঠান ছিল এটা তারউপর সব নাম করা শিল্পীদের  নিয়ে অনুষ্ঠান।

     সাধারণতঃ আমি ব্রেকিং নিউজ কভার করি আর আমাদের দেশের স্বনামধন্য রাজনৈতিক নেতাদের প্রেস মিটের ডাক পরলে কিম্বা ইন্টারভিউ নেবার দরকার পরলে যাই, যদিও আমার হাতে থাকে না তবুও সিনসিয়ার রিপোর্টার হিসেবে কিছু নাম হওয়াতে কখনও কখনও মত প্রকাশ করি এবং মান্যতাও পাই ।

       সেদিন মল্লিকা মঞ্চে উঠেছিল হালকা হলুদ রঙের  সিল্কের শাড়ি শান্তিনিকেতনের ছাপ ছিল তাতে, সামান্য প্রসাধন ছিল মুখের সাজে । আমি অবাক হয়ে ওর সাবলীল মঞ্চের উপস্থাপনা দেখেছিলাম।

        অনুষ্ঠানটি শারদীয়ার হলেও রবীন্দ্রনাথ যেন ভীষনভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল সমস্ত শিল্পীদের নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখার চেষ্টায়। মল্লিকা কখনও রবীন্দ্রনাথের গান গাইছে দুলাইন শিল্পীকে ডাকার মুহূর্তে কখনও রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন।

       মল্লিকার সাবলীল সঞ্চলনা আমাকে আবিষ্ট করলো না মল্লিকার সুমধুর কন্ঠস্বর আমাকে মূর্ছনায় ভরিয়ে রাখলো বুঝতে বুঝতে অনুষ্ঠান শেষে হয়ে গেল। পরিচিত এক ক্লাব সদস্যকে ধরে ওর সঙ্গে আলাপ করলাম মুগ্ধ দর্শক হিসাবে। সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে কারণ তখন অনেকের কাছে আমি পরিচিত মুখ তবু ওর কাছে সাধারণ হয়ে ধরা দিতে চাইলাম।

       মল্লিকা ওর স্বভাবসুলভ সহজ সরল মনে আমার কথার চাতুরীতে ওর বন্ধু ভেবে নিল আমাকে কোনরকম জড়তা ছাড়ায়। ওকে বলেছিলাম কফি খেতে পাশের কফিসপে কিছুক্ষণ ওর সঙ্গে কাটাবার অছিলায়। 

       মল্লিকা হেসে বলেছিল আজকে নয় অনেক রাত হয়ে গেছে আমি বাড়িতে না পৌঁছালে বড়বৌদি ঠাঁই বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবে। তখন আমি ওকে আমার গাড়িতে পৌঁছে দিতে পারি ও যদি সম্মতি দেয় বলেছিলাম। মল্লিকার উত্তর ছিল আপত্তি নেই তবে ওদের বাড়িতে এক কাপ কফি খেতে হবে আমাকে।

       আমার ক্যামেরাম্যানকে ছুটি দিয়ে অন্য একটা কাজ সারার অজুহাতে মল্লিকাকে নিয়ে আমি চলেছিলাম। আমি সেইরকম ভাবে কোন মেয়ের সান্নিধ্যে আসিনি, কখনও কাউকে ভালো লাগলেও এইরকম মুগ্ধতার আবেশ তৈরি হয়নি আমার।

        আমি গাড়ি চালাচ্ছিলাম আমার পাশে মল্লিকা।ওর কথাতে জানলাম ও ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে ইংলিশে মাষ্টার্স করছে। ওরা ছয় ভাইবোন --ওর বাবাকে ওর মনে নেই,মাও স্কুলে পড়ার সময় চলে গেছেন। মল্লিকার বড়দা আর বড়দি ওদের মানুষ করেছেন, মায়ের মৃত্যুর পর বড়বৌদি ওর মায়ের মত সারাক্ষন আগলে রাখেন, মল্লিকা তাই কখনো মায়ের অভাব বোঝেনি । বড়দি আর ছোড়দা বিয়ে করেননি বাকি দুই দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। মল্লিকায় সবার ছোট।

        গাড়ি চলার এই সময়ের মধ্যে মল্লিকা আমার খুব কাছের মানুষ হয়ে গেল। ওদের বাড়ির সামনে পৌঁছাতেই মল্লিকা আমাকে ইশারায় দেখালো ওর বড়বৌদি দোতলার বারান্দায় ওর জন্য দাঁড়িয়ে আছেন।

        মল্লিকার জোড়াজুড়িতে ওদের বাড়িতে ঢুকতেই হলো কিন্তু অবাক হলাম এই কলকাতা শহরে এইরকম আন্তরিকতা দেখে। কারুর ব্যবহারে বুঝতে পারলাম না আমি একদম অপরিচিত মানুষ ওনাদের কাছে এই প্রথম ওনাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে।

         মা আর আমি  এই আমাদের ছোট্ট পরিবার। ছোট থেকে অনেক প্রতিকূলতার সঙ্গে বড় হয়েছি। আত্মীয় স্বজনের কোন আন্তরিকতা পাইনি । মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে, চেনাজানা হয়েছে তবে সেগুলো একটা গন্ডীর মধ্যে, মনের গভীরে রেখাপাত করার মত নয়। যাঁর যতটুকু প্রয়োজন সে ততটুকুই থেকেছে এই কঠিন বাস্তবতার যুগে।

         কফি খাওয়া তারপর নানা কথাবার্তা পর যখন মল্লিকাদের বাড়ি থেকে বেরোলাম আমার সবটায় কেমন স্বপ্ন মনে হলো। জানি না আমার ব্যস্ততার জীবনে আর কোনদিন মল্লিকার সঙ্গে দেখা হবে কিনা। 

         যোগাযোগ কি করে রাখবো এইরকম নানা চিন্তায় বাড়িতে পৌঁছালাম। পরেরদিন অফিস গিয়ে শুনলাম আমাকে দিল্লি যেতে হবে আসন্ন ভোটের জন্য প্রধান মন্ত্রীর ভোটের প্রচারের পনের দিন বিভিন্ন রাজ্য সফরের সঙ্গী হয়ে। সরাসরি সম্প্রচার করতে হবে আমাকে, আমার সঙ্গে দিল্লির  ক্যামেরাম্যান  থাকবে।

         

Comments

Popular posts from this blog

আমার স্বপ্নের ঘর

মল্লিকাঅর্জুন ( চতুর্থ পর্ব)

আমি সেই মেয়েটা