অপ্রকাশিত গল্প (শেষ অংশ)
** অপ্রকাশিত গল্প (শেষ অংশ) **
চিঠিটা পড়তে পড়তে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো কিছুক্ষণ নিজেকে সামলে পরের চিঠিতে ----
প্রিয়
তোমাকে দীর্ঘ কুড়ি বছর পর চিঠি লিখছি --- ভেবেছিলাম তোমাকে আর বিরক্ত করবো না -- তোমাকে দেখতে বড় ইচ্ছে করছে আজকে--- আমার ছুটির ঘন্টা বেজে গেছে যেকোন সময় চলে যাবার ডাক আসবে--- তাই শেষ অনুরোধ --- একবার যদি আসো আমি দূর থেকে তোমাকে দুচোখ ভরে দেখবো--- আমার নব যৌবনে যে ঝংকার তুমি বাজিয়ে ছিলে আরেকটি বার সেই অনুভূতির আবেশে ---আমি ঘুমিয়ে পরতে চাই সব না পাওয়ার হিসেব মিটিয়ে। সেদিনও তোমার অপেক্ষায় ছিলাম ছাতনাতলায় যাবার আগের মূহূর্ত পর্যন্ত---তারপর দেখলাম তুমি আমার বিশ্বাসকে মিথ্যা প্রমান করলে-- মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলাম -- মা ভেবেছিলেন পর হয়ে যাবার দুঃখে আমি কাঁদছি।
তারপর গতানুগতিক ধারায় এই বাড়িতে কুড়িটা বছর কাটিয়ে দিলাম -- আমার একছেলে-একমেয়ে তাদের বড় করেছি, এখন যদিও তাদের পড়াশোনা শেষ হয়নি---আর তোমার বদলে যিনি এসেছেন আমার জীবনে তিনিও ইন্দ্রানীকে ছাড়া চোখে অন্ধকার দেখেন--- আমি একটা স্ত্রীর যা ধর্ম -- যা কর্তব্য --সব পালন করেছি মনের যন্ত্রণা সব লুকিয়ে--- নিজের কথা ভাবার অবকাশ পাইনি--- তবে একাকীত্ব সময়গুলোতে তোমার সঙ্গে কাটানোর স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে অনুভব করতাম তোমার সেই ডাক ---" ইন্দু" ! ---। এখানে সবার কাছে আমি "ইন্দ্রানী "---গাল ভরা এই সম্ভাষণে আমি ক্লান্ত -- আমি শুনতে চাই আরেকটি বার তোমার সেই ডাক -- "ইন্দু" !। রইলাম তোমার প্রতিক্ষায়---।
ইতি
" ইন্দু "
মনে পরে গেল ইন্দুর এই চিঠিটা পেয়ে নিজেকে সামলাতে পারিনি মায়ের সমস্ত দিব্যিকে মাথায় তুলে রেখে ছুটে ছিলাম "ইন্দুর" কাছে---। যার মঙ্গলের কথা ভেবে আমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম --- আমার মানসপ্রতিমার এইরকম অবস্থায় মানতে পারি নি --- কিন্তু বিধাতা আমাকে একটুও সুযোগ দিলেন না---।আমি ইন্দুর ঠিকানা মত পৌঁছে গেটের দারোয়ানকে বললাম তোমাদের বৌদিমণির গ্রাম থেকে এসেছি একটু দেখা করবো--- । আমার কথা শেষ হতেই দারোয়ান কেঁদে উঠলো বলল দাদাবাবু আরেকদিন আগে এলেন না--বৌদিমণি গতকাল রাতে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন-- এইতো সবাই শেষ কাজ করে ফিরে এলো--। আমার সেই মূহূর্ত মনে হলো পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠল---আমার আমার "ইন্দু " আমাকে চরম শিক্ষা দিয়ে চলে গেছে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে---। আমি আর কিছু না বলে উল্টো রাস্তা ধরলাম -- সেই থেকে আমার অনুশোচনা আমাকে বারবার বলে--- বেঁচে থেকে আমার কি লাভ যেখানে আমার " ইন্দু" নেই---। তবুও তো এতদিন জানতাম আমার "ইন্দু" ভালো আছে কোথাও।
আমার স্কুলের বন্ধু মৃনালের একমাত্র বোনকে আমার খুব ভাললাগতো সেই স্কুলে পড়ার সময় থেকে---মৃনাল বিশাল বড়লোকের ছেলে আর আমি বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান--- "মা" আমার বাবার সরকারি চাকরির কিছু অনুদান আর সামান্য কিছু জমি-জায়গার উপর ভিত্তি করে আমাকে মানুষ করেছিলেন---- আমি পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলাম, ক্লাসে প্রথম হতাম-- হয়তো সেই কারণে বড়লোক বাড়ির ছেলের আমি একমাত্র বন্ধু হয়েছিলাম।
ওদের বাড়িতে আমার অগাধ আধিপত্য ছিল--- মৃনালের বোন ইন্দ্রাণী বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি আর ইন্দ্রানী সবার চোখ ফ--াঁকি দিয়ে করতে করতে গভীর ভালবাসায় জড়িয় জড়িয়েে পরলামলাম।---- তখন জীবনের আবর্ত ইন্দুকে ঘিরেই আবর্তিত হতো আমার--- ইন্দু এমন মেয়ে যাকে ভালবাসা যায় হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে--- পারস্পরিক বোঝাপড়ায় আমাদের ভালবাসা স্বর্গীয় হয়ে উঠেছিল -- অনুভবে, অনুভূতিতে ভালবাসার উন্মাদনায় ভেসে ছিলাম আমরা কয়েক বছর কিন্তু বিধাতা হয়তো চাননি -- তাই আমি আজ একা হারিয়ে ফেলা ভালবাসার স্মৃতি নিয়ে--।
বাড়িতে এলে প্রথম প্রথম দূর্বার আকর্ষণে ছুটে যেতাম ওদের বাড়িতে , একটু চোখের দেখা দেখার জন্য ছটপট করতাম আমার মানসপ্রতিমাকে । সেদিন ওদের বাড়ির ফিরে মাকে ইন্দ্রাণীর কথা বলতেই মা কেমন রেগে উঠলো-- বললেন ওসব কথা মাথায় এনো না আমি তোমার মাসীকে কথা দিয়ে দিয়েছি ,--ওর ননদের মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবো এবং সেটাই হবে ,---- মা বললেন শুধু তোমাকে নিয়ে গিয়ে দিনটা ঠিক করে আসবো এটাই শেষ কথা।--- তাছাড়া মেয়েটি খুব সুশ্রী ও খুব লক্ষ্মী মন্ত, মেয়েটিকে আমার খুব পছন্দ ---। মাকে বললাম এতদিন তুমি যা বলেছো আমি শুনেছি "মা", এবার আমার নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত আমাকে নিতে দাও। হঠাৎ মা আমার হাতটা মায়ের মাথায় উপর রেখে বললেন আমার কথার অন্যথা হলে আমার মড়া মুখ দেখবি এবং ওই মেয়েরও চরম সর্বনাশ হবে মনে রাখিস।
--মায়ের মুখে ওই কথা শোনার পর পর মাকে কেমন অচেনা মানুষ মনে হলো আমার,---- তারপর চুপচাপ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম কথা না বাড়িয়ে ---আর বাড়ি মুখো হতাম না।--- মায়ের জন্য টাকা সময় মত পাঠিয়ে দিতাম--- দুবার মায়ের অসুখের সময় গেছি ,ডাক্তার-- ঔষুধ ব্যবস্থা করে চলে এসেছি থাকিনি--- । বাড়ি যেতে ইচ্ছে করতো না --তাছাড়া আমার সেই মাসী আমাদের বাড়িতে এসে পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করেছিলেন--- ।
মায়ের শেষ কাজ করার পর সেই যে চলে এসেছি আর গ্রামে যায়নি শুধুমাত্র ।--মাত্র"ইন্দুর" কোন ক্ষতি চাইনি বলেই--- এখন বুঝি কুসংস্কার মানা উচিত হয়নি হয়তো মাতৃ আজ্ঞাকে অবজ্ঞা করা হতো ঠিকই তবুও দুটো জীবন তো শেষ হতো না--- যতই হোক মা তো ঠিক ক্ষমা করতেন আমরা ভালো থাকলে---অনুশোচনায় ছটপট করি ---ভুলতে পারিনি বলেই "ইন্দুকে" আমার মন জুড়ে রেখে কাটিয়ে দিলাম একাকী এতোগুলো বছর --। আমার "ইন্দুর" জায়গায় আমি কাউকে বসাতে চাইনা---। "ইন্দু" থাকুক আমার স্মৃতির পাতা জড়িয়ে আমার সর্বস্ব ভালবাসা নিয়ে।আর তার জন্য "ইন্দু" আমাকে চরম শাস্তি দিয়েছে যা আমি কোনদিন ভাবতেও পারিনি।
Comments
Post a Comment