জবানবন্দী (১ম পর্ব)

** জবানবন্দী (১ ম পর্ব) **


 আপনারা এই জবানবন্দী কথাটা পড়ে ভাবছেন তো কোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কোন মেয়ে তার কোন অপরাধের কথা বলছে ?,না না সেই রকম কিছু নয় আমি খুব সাধারন একটা মেয়ে নিজের কিছু কথা বলছি যেগুলো আমার মনের মধ্যে ছিল সংগোপনে একান্ত আমার হয়ে। লিখছি আর ভাবছি এই লেখার কোন যৌক্তিকতা আছে কিনা?, যা মানুষের মনে রেখাপাত করে না সেইসব জিনিস তো আলপনার মত মুছে যায় সময়ের আর্বতনে। তবু নিজের অন্তরে উঁকি দিয়ে দেখলাম জমে আছে মনের কিছু সংলাপ তাকে শব্দে , ভাষায় লিপিবদ্ধ করলাম।

আমি নিজেকে জাহির করতে পারিনা,যা আমি নয় তাকে রঙ চড়িয়ে বলে সবার কাছে মহৎ হতে পারিনা। আমি অন্তর্মুখী, নিজের যন্ত্রণা প্রকাশ করতে পারিনা। অন্যায় বুঝেও প্রতিবাদী হতে পারিনা,সহ্য করা আমার অভ্যাসে রপ্ত করেছি। জীবনের রঙ্গশালায় অভিনয় দেখেছি অনেকেরই। মুখোশ ধারী ও দেখেছি ভালমানুষ সেজে থাকার। তবে তাদের অনুকরণ করতে মন সায় দেয়নি বরং মনে হয়েছে আমার আমিত্বকে হারিয়ে ফেললে নিজের বিবেকের কাছে কি জবাব দেবো। আমার মনে হয় মানুষ যখন নিজের বিবেকের কাছে অপরাধী হয় তখন মানুষ জন্মই বৃথা হয়ে যায়। তখন মনে সুখ জিনিসটা থাকে না অন্তরজ্বালায় দগ্ধ হতে হতে একসময় ঠিক বেঠিকের অনুশোচনায় মনে হয় এ আমি কি করলাম।

 আমার মনুষ্যত্ব বোধ আমাকে মানুষ দেবতাদের অন্তরের শ্রদ্ধায় পূজো করতে শিখিয়েছে । আমি সাধারণ মেয়ে হয়েও তথাকথিত দেবদেবীর আরাধনায় অত মনের সাই পাইনা, তবে ওই যে আমার কিছু দূর্বলতা আছে তাই নাস্তিক হতে পারিনা। হ্যাঁ সবার মতো পূজো করি, মন্ত্র বলি ,ফুল বেলপাতা দিই । আবার ভাবি এই দেবতার অস্তিত্ব থাকুক বা না থাকুক দেবতার অস্তিত্ব কল্পনায় মানুষের অবচেতন মন একটা আশ্রয় খোঁজে। এই আশ্রয়স্থল আছে বলেই মানুষ কতরকমের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবার সাহস পায় নইলে আশাহীন জীবন যাপনে লড়াই করার মনোবলই হারিয়ে যেত। আমার ঠাকুর আমায় ঠিক রক্ষা করবেন এই যে বিশ্বাস কত মানুষকে মনোবল যোগায় কঠিন পথে হাঁটতে তার কোন হিসাব নেই । আমার খুব কাছের মানুষজনকে দেখে এই অভিজ্ঞতায় হয়েছে আমার।
 
আমি দেখেছি গরীব , মধ্যবিত্তের লড়াই জীবনের প্রতিটি বাঁকে তেমনি এদের মনের বিশ্বাসের ভিত তত মজবুত দেবতাই তাদের আশ্রয় স্থল বলে। যাঁরা বিত্তশালী তাঁরা মানুষ ক্ষুদায় কাঁদলেও তাকিয়ে দেখেনা তবে দেবতাদের দামী উপঢৌকোন দিয়ে খুশী করার চেষ্টা করেন। এইরকম অনেক ঘটনায় ঘটেছে আমাদের আশেপাশে যেগুলো দেখে আমার মনের ভেতর বিদ্রোহ করলেও দূর্বল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য প্রতিবাদী হতে পারিনা। হ্যাঁ অনেক মানুষ আছেন এই সমাজে তারা নিজেদের জীবন বিপন্ন করেও অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করেন আমি সেইসব মানুষদেরকে সবসময় অন্তরের শ্রদ্ধায় প্রনাম জানাই। নিজের অক্ষমতাকে সান্ত্বনা দিই পরজন্মে পুষিয়ে নেবো সব আমার ঘাটতি গুলোকে।
 
না না আমি জ্ঞানের কথা বলছি না আমি আমার উপলব্ধি প্রকাশ করছি মাত্র। আচ্ছা সত্যি কথা বলুন তো আজ আমরা বিংশ শতাব্দীর এসেও কেন একটা মেয়ের দিকে আঙ্গুল তুলি। কোন মেয়ের নিজের ইচ্ছা মতন স্বাধীন জীবন যাপন করা মানেই কি সে উচ্ছৃঙ্খল। কেন একটা মেয়ের নিজের মত করে বাঁচার অধিকার থাকবে না। আগের দিনে যখন বাড়ির অন্দরমহল বলে একটা জায়গা ছিল যেখানে মেয়েরা মানুষের সম্মান পেতনা উপরন্তু নানা সংস্কার,অন্ধকুসংস্কারে তাদের জীবনকে দূর্বিসহ করা হতো। তখন কত মেয়েকে সতী বলে জীবন্ত দাহ করা হয়েছে,কত মেয়েকে বিধবা সাজিয়ে কুমারী থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত তাদের বেঁচে থাকাটা দূর্বিসহ করেছিল সমাজ ব্যবস্থা আমরা সবাই জানি তা। তারপর আস্তে আস্তে এই সমাজের বিবর্তন, তাঁর সুফলতায় জন্যই মেয়েদের আজকের এই উত্তরণ ঘটেছে।অবশ্যই কিছু মহান মহাপুরুষের চেষ্টায় এবং সেই সব মেয়েদের চেষ্টায় যাঁরা সমসাময়িক সমাজের মাথাদের কাছে লাঞ্ছিত হয়েছেন তবু মেয়েদের বোবা যন্ত্রণার থেকে মুক্তি দিয়ে আজকের মেয়েদের শিক্ষায় ,চেতনায় নব উত্তরণ ঘটিয়েছেন।

 আজকে মেয়েদের শিক্ষার উৎকর্ষতা ও সর্বকাজে পারদর্শীতার কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তবে এটাও ঠিক আমাদের মতো সাধারণ মেয়েদের উত্তরণ এখনও সেই ভাবে হয়নি হয়তো আমরাই চাইনা বলেই। আমরা সাধারণ মেয়েরা এখনও কাছের মানুষের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে দুবার ভাবিনা। আমাদের মানসিক গঠন‌ এমন যে আমরা নিজেদের কথা ভাবিনা বরং ভাবি কিসে আমার চারপাশের মানুষ ভালো থাকবে। এই মনোভাব সমস্ত সাধারণ মেয়েদের তাঁরা আত্মসুখে বিভোর হয়ে অন্যের কষ্টের কারণ হয়না। অনেক অমানবিক আচরণ সহ্য করেও ভালবাসার মানুষের মঙ্গল কামনায় থেকে কখনও তাঁরা বিরত হয়না। তবে ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে সেই পৌরাণিক যুগ থেকে বর্তমান যুগেও আছে কিছু মেয়ে যাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা , নম্রতার অভাব এবং আত্মসর্বসুখ বিলাসে দিন যাপন একমাত্র চাওয়া তাদের।

আবার আমার চোখে পুরুষ মানুষরা সমালোচনার উর্ধ্বে কারণ পুরুষের মানসিক গঠন‌ তো আমার মতো কোন নারীর দ্বারাই তৈরী হয়েছে। মায়ের শিক্ষা ব্যতিক্রম ঘটনা ছাড়া সব সন্তানের উপর প্রভাব বিস্তার করে। যেমন আমার বাবা আমার ঠাকুমার এবং তার দিদিদের আচার-আচরণ শিক্ষায় সমৃদ্ধ, তেমনি আমি ও দাদা,ভাই তো একই মায়ের শিক্ষায় আলোকিত। আমার জীবন সঙ্গী যে আমাকে শিখিয়েছিলেন মেয়ে জন্ম সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপহার । আমার জীবন সঙ্গী তো এই শিক্ষা পেয়েছিলেন তাঁর মায়ের কাছেই। তেমন আমি আমার মূল্যবোধ, আমার রুচি ,আমার চেতনা দিয়ে আমার উত্তরসূরীকে আজকে সমাজে চলার উপযুক্ত করেছি। তাই আমার বিশ্বাস কিছু পুরুষের বিকৃত রুচি দিয়ে সমগ্র পুরুষ জাতির বিচার করা উচিত নয়। সমাজে বিকৃত রুচির মানুষেরা বেশিদিন মাথা তুলে থাকতে পারবে না কারণ চরিত্রহীন লম্পটদের সমাজে কোন সম্মানের জায়গা থাকেনা। এরা মানুষের ঘৃণায়, মানুষের অবজ্ঞায় মানুষের পায়ের তলায় দলিত হয়ে একদিন অবলুপ্ত হবেই এই বিশ্বাস আমি করি।
 

Comments

Popular posts from this blog

আমার স্বপ্নের ঘর

মল্লিকাঅর্জুন ( চতুর্থ পর্ব)

আমি সেই মেয়েটা