একটি মেয়ের উত্তরণের গল্প (৭ম,৮ম পর্ব)

** একটা মেয়ের উত্তরণের গল্প  ( ৭ম পর্ব) **


ওই যে শ্যামার কথা বলছিলাম বেচারা এখন যেন সে মেয়ে জন্মের খেসারত দিচ্ছে । যা বুঝেছিলাম শ্যামাকে পরীক্ষা করে  গর্ভধারণ থেকে প্রসবের সময়  পর্যন্ত ওকে  সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে । কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে ওদের পরিবারের এতজন সদস্যদের সমস্ত খাওয়া -দাওয়ার চারবেলার ব্যবস্থা করতে ওকেই হয়। শ্যামার শ্বাশুড়ীমা আবার ছুঁচিবাই গ্রস্ত মহিলা কারুর ছোঁয়া খাবেন না, ঘরের ভিতর কোন কাজের লোককে ঢুকতে দেবেন না। তাই ঘর ঝাড়ু, মোছার কাজও শ্যামাকে করতে হয় যেটা গর্ভবতী শ্যামার জীবনে সবচেয়ে অভিশাপের কাজ করে । 

শ্যামার দুই ননদ, একজন দশ বছর, একজন বারোবছর । বারো বছর যার বয়েস তার আবার কয়েকমাস পরেই বিয়ে ,শ্যামা বারো বছরের মেয়ে যখন  বিয়ে হয়  তারপর থেকেই ওকে সংসারের হাল ধরতে হয় অথচ ওর ননদেরা বৌদিকে সাহায্য করতে গেলে শ্যামাকে কথা শুনতে হয় কারণ তার আদরের মেয়েদের নাকি এখন কাজ করার বয়েস হয়নি ।শ্যামার বরের সময় নেই তবু ছুটির দিন চেষ্টা করে কিন্তু মায়ের কথার আক্রমণে পারে না কিছু করতে, শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাড়া । বিয়ের দুবছর পর শ্যামা প্রথম গর্ভবতী হয় কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তা নষ্ট হয়ে যায় ।

 আমি সব শুনে শ্যামার বরকে বললাম "শ্যামা এখন দুমাস হলো  সবে গর্ভবতী হয়েছে ,ওকে এবং ওর বাচ্চাকে বাঁচাতে চাইলে ওকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে । শ্যামার শরীরে পর পর দুবছর দুটো বাচ্চা নষ্ট হওয়ার দরুণ  অনেক ধকল গেছে, ও   শারীরিকভাবে খুব দূর্বল এবং অপুষ্টিতে ভুগছে । শরীরে রক্ত কম,ওর প্রয়োজন এই সময়ে একটু পুষ্টি যুক্ত খাবার যেমন দুধ,ডিম,ফল "। শ্যামার বর বলল "এইটুকু তো আমি ওর জন্য করতেই পারি কিন্তু আমি কিনে আনলে মা ওকে একা খেতেও দেবেনা আর বিশ্রাম জানি না কি করে সম্ভব হবে"। 

শ্যামার বরের এই কথা শুনে আমার প্রচন্ড রাগ হলো বললাম  "আপনি কি রকম পুরুষ মানুষ ,আপনার নিজের বৌয়ের জন্য এইটুকু করতে পারবেন না এদিকে আপনাদের বাচ্চা চাই। গর্ভবতী অবস্থায় কেউ ঘর মোছে , না কাপড় কাচে"। শ্যামার বর বলল "দিদি আপনি জানেন না আমি শ্যামার হয়ে সামান্য কিছু বললে আমার মা খাওয়া ছেড়ে চরম অশান্তি করে। কি করবো বলুন শ্যামাকে কথা শোনার হাত থেকে বাঁচার জন্য অন্যায় দেখেও চুপ করে থাকি।

 আমি কিছু বললে মায়ের সমস্ত রাগ শ্যামার উপর পরে।শ্যামা শান্ত মেয়ে কিছু বলতে পারে না শুধু চোখের জল ফেলে"। আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললাম "আপনি এককাজ করুন আমি লিখে দিচ্ছি শ্যামা এই কয়েকমাস হাসপাতালে থাক। আপনি বাড়িতে গিয়ে বলুন ডাক্তার ওকে ভর্তি করে নিয়েছেন"। শ্যামা শুনে করুণ সুরে বলল "আমি কি করে এতোদিন হাসপাতালে থাকবো" । আমি বললাম "তোমার ভালোর জন্য এই ব্যবস্থা, নইলে তুমি কোনদিন মা হতে তো পারবেই না বরং নিজে বাঁচবে কিনা সেটাও ভাবনার বিষয়" ।

শ্যামার বর বললেন "ডাক্তার দিদি আপনি ব্যবস্থা করেই দিন শ্যামা এখানে থাক এই কয়েকমাস, তুমি কিছু ভেবোনা শ্যামা দেখতে দেখতে কেটে যাবে কমাস। আর আমি তো রোজ আসবো তোমার কাছে"। আমি শ্যামাকে ভর্তি ব্যবস্থা এবং ওর স্পেশাল খাবার চার্ট করে দিয়ে বাড়ি চলে এসেছি ।

 পরেরদিন হাসপাতালে গিয়ে শুনি এক ভদ্রমহিলা সবার বাধা কে অগ্রাহ্য করে ভিতরে চিৎকার চেঁচামেচি করছে। আমি পেশেন্টদের অপেক্ষা করতে বলে ওয়ার্ডে গিয়ে শুনি  শ্যামার শ্বাশুড়ীমা, শ্বশুর মশাই এসেছেন,দেখলাম  শ্বশুর মশাই একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে আর ভদ্র মহিলা বলছেন "তুমি এখনই আমার সঙ্গে চল ,যত সব আদিখ্যেতা আমাদের যেন বাচ্চা হয়নি। সংসারে সব কাজ করে চারটে ছেলে মেয়ের জন্ম দিয়েছি আর লাট সাহেবের কন্যা তোমার বিশ্রাম চাই"। আমি উনাকে  বললাম "আপনি ওয়ার্ডের ভিতর চিৎকার চেঁচামেচি করবেন না এখানে অসুস্থ মানুষেরা আছেন"। উনি আপাদমস্তক আমাকে নিরীক্ষণ করলেন তারপর বললেন "ও বুঝতে পেরেছি আপনি তাহলে  সেই ডাক্তার যে শ্যামাকে হাসপাতালে থাকার বিধান দিয়েছেন" ।
 
 আমি বললাম "হ্যাঁ শ্যামার শারীরিক অবস্থা দেখে আমাকে এই ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হতে হয়েছে"। উনি বললেন  "তাহলে  আমাদের সংসার চলবে কি করে, আমার বাতের ব্যাথায় আমি তো নড়তে পারি না" । আমি বললাম "শ্যামার যখন বিয়ে হয়েছিল তখন ওর বয়েস কত ছিল ,উনি বললেন কত আর ধেড়ে বয়েসে তো বিয়ে হয়েছে বারো বছর পেরিয়ে গেছিল" ।আমি বললাম "বিয়ে পর থেকেই তো আপনার  সংসারের  হাল তো শ্যামার ঘাড়ে তাই নয়কি"। 
 
উনি ঝাঁঝিয়ে আমাকে উত্তর দিলেন "ছেলের বৌকে কি ঘরে সাজিয়ে রাখার জন্য আমি ছেলের বিয়ে দিয়েছি বুঝি"। আমি বললাম "না সেতো নয় অবশ্যই এইরকম মানসিকতা হবে আপনার ভাবছি না। মেয়েদের সঙ্গে এতো উদার ব্যবহার হবে ভাবাই যায় না হয়তো কোন একদিন এই চিন্তাধারার পরিবর্তন হবে নিশ্চয়ই "। উনি বললেন "লেখাপড়া শিখলে বুঝি বড়দের মান্যি করতে নেই"। আমি বললাম "লেখাপড়ায় তো আমাকে শিখিয়েছে অন্যায়ের সঙ্গে কোনদিন আপসোস না করতে সে যেই হোক" ।
 
 উনি বললেন "তোমার ন্যায়,অন্যায় তোমার কাছে রাখো আমার ঘরের বৌকে আমি কি বলবো সেটা আমার ব্যাপার"। আমি শান্ত হয়ে বললাম "আপনার ঘরের বউ আপনার কথা শুনতে গিয়ে  দুবার ওর বাচ্চা নষ্ট করে ফেলেছে।এইবার ও আমার পেশেন্ট তাই আমার দায়িত্ব ওকে দেখা যাতে সুস্থ একটা বাচ্চার জন্ম দিতে পারে। আর আপনাকে বুঝতে হবে সবার শারীরিক অবস্থা সমান নয়,আর একটা মেয়ের শারীরিক ভাবে বারো,চোদ্দবছরে সক্ষম হয়না বাচ্চা জন্ম দেবার" । 
 
"যার জন্য বেশি ভাগ মেয়ে বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়  । শ্যামা তো আগে কোন  ডাক্তার কাছেই যাইনি যার জন্য আজকে ওর এই অবস্থা ।আপনি একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের উপর কি করে এতটা  নির্দয় হতে পারেন"। শ্যামার শ্বশুর মশাই এতক্ষণে বললেন "ঠিক আছে বৌমা বাড়িতে চলুক আমরা বৌমাকে দেখে শুনে রাখবো"। 

আমি বললাম "ওর বর ওকে ভর্তি করেছে তাই বরের সম্মতি ছাড়া তো ওকে ছাড়া যাবে না" । শ্বাশুড়ীমা গলা চড়িয়ে বললেন "আমি ওর বরের মা আমাকে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করতে হবে এখন" ।আমি বললাম "আপনি নিয়ে যাবেন নিয়ে যান কিন্তু আপনার এই মানসিকতা থাকলে ছেলের চারটে বিয়ে দিলেও আপনার নাতি,নাতনি দেখার সৌভাগ্য হবে না ।আপনার দুই মেয়ে ও আপনি মিলে আপনাদের সংসার এইকয়েক মাস চালিয়ে নিন, দেখবেন কয়েকমাস পর আপনার ঘরে শ্যামা একটা ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে হাজির হবে । শ্যামাকে একটু  আপনার নিজের মেয়ের ভাবুন না তাহলে দেখবেন সবকিছু ভালোই হবে"। তখন উনি বললেন "ডাক্তার মেয়ে তবে তুমি কথা দিচ্ছো এবার আমি ঠাকুমা হবোই"। আমি বললাম "ভরসা রাখুন ভগবানের উপর আর আমি তো আছিই"। 

জানো ওই ভদ্রমহিলা নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে শ্যামার কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত দিয়ে বললেন "ডাক্তার মেয়ের কথা শুনে ভালো থেকো ।যা খেতে ইচ্ছা করবে খোকাকে দিয়ে বলে পাঠাবে আমি পাঠিয়ে দেবো , সাবধানে থেকো তুমি "-বলে চলে গেলেন। আমি মাঝেমধ্যে ফল এটা সেটা শ্যামার জন্য নিয়ে যাই কেমন মায়া পরে গেছে ওর উপর। ওর কোন চাহিদা নেই শুধু ও মা হতে চায় ।

এইভাবে কয়েকমাস কেটে গেল সেদিন সকাল থেকে শ্যামার শরীরটা ভালো ছিল না,আমার মনে হচ্ছিল সময় হয়ে এসেছে আজকেই শ্যামার প্রসব যন্ত্রণা উঠবে। আমি হাসপাতালে থেকে গেলাম, মাকে বলে এসেছিলাম আজকে বাড়িতে ফিরতে নাও পারি ,মা শ্যামার কথা জানতেন আমি সব বলেছিলাম মাকে। সেইজন্য মা মাঝেমধ্যে খবর নিতেন শ্যামা কেমন আছে। শ্যামাকে লেবার রুমে নিয়ে আসা হয়েছে  । আমি আছি,সিনিয়র ডাক্তার সোম আছেন, আর আমার মতো লেডি ডাক্তার মধুমিতা । 

 ঘন্টা দুয়েক লড়াইয়ের পর শ্যামা একটা ফুটফুটে ছেলের জন্ম দিয়েছে । বাচ্চার কান্নার আওয়াজে শ্যামা সব যন্ত্রণা ভুলে হাসি মুখে তাকাল আমার দিকে। বাইরে অপেক্ষা করছিল ওর বর আর শ্বশুরমশাই আমি তাদেরকে সুখবরটা দিলাম। শ্যামার বর হাত জোড় করে আমাকে বলল "দিদি আমার শ্যামা ভালো আছে তো" । আমি বললাম "হ্যাঁ শ্যামা ভালো আছে এবং আপনার  সন্তান ও ভালো আছে", একটু পরে ওদের বেডে দিলে আপনারা গিয়ে একবার দেখে আসবেন তবে বেশি কথা বলবেন না" । ভোরবেলায় আমি হাসপাতালের গাড়ি করে বাড়ি ফিরলাম একটা মেয়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে ।

( ৮)
** একটি মেয়ের উত্তরণের গল্প ( ৮ম পর্ব)**

জানো আনন্দ হাসপাতালে চাকরি করতে এসে দেখলাম মেয়েদের সমস্যার শেষ নেই । জানো তো আমার উপলব্ধি মেয়েদের এই দুর্দশা কমতে পারে  একমাত্র শিক্ষার আলোয় যখন প্রতিটি মেয়ে উপলব্ধি করবে স্বাবলম্বী হবার ,পরনির্ভরশীল হয়ে থাকা নয় নিজেকে বাঁচতে হবে নিজের উপর আস্থা রেখে। 
ভালোবাসার জন্য ত্যাগ তো থাকবে  তাই বলে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে নয়, আত্ম সম্মান বোধ থাকতে হবে। এই কথা বিশ্বাস  রাখতে হবে যে মেয়ে জন্ম কোন পাপের নয়। সমাজের লিঙ্গ বৈষম্য জেরে অনেক অনেক লড়াই করতে হবে প্রতিটি পদে তাই বলে মনোবল হারিয়ে ফেললে চলবে না। 

সংসারে নিজস্বতা বজায় রাখার স্বার্থে নিজের উপর ভরসা রাখতে হবে, তুমিই তো বুঝিয়ে ছিলে পারবো না বলে কিছু হয়না ,চেষ্টা করে যেতে হবে। জীবনে সফলতা অর্জন করতে গেলে মনোবল অক্ষুন্ন রেখে এগিয়ে যেতে হবে ।
 তোমাকে যেটা বলতে চাইছিলাম "কয়েক মাস আগে একটা কলেজে পড়া বেশ সুন্দর দেখতে একটা  মেয়েকে ওর বন্ধুরা ধরাধরি করে নিয়ে এসেছে হাসপাতালে । সেইসময় এমার্জেন্সিতে আমি ছিলাম ডিউটিতে, ওর বন্ধুদের কাছে  জানতে পারলাম ও কলেজ হোস্টেলে থাকে"। 
 
"ওর বন্ধুরা হঠাৎ দেখে   ওকে, ওদের ধারণা ও কিছু খেয়েছে যার জন্য ওর এই অবস্থা। চারটে মেয়ে সঙ্গে দুটো ছেলে, মেয়েটা মেয়েদের হোস্টেলেই থাকে, ছেলে দুটো ওদের বন্ধু সম্ভবতঃ। যাইহোক আমি পরীক্ষা করে ওদের বাইরে বসতে বলে ওর চিকিৎসা শুরু করি। ঘন্টা দুয়েক পর মেয়েটির জ্ঞান আসে। আমি ওর বন্ধুদের নিশ্চিন্ত করে, ওদের চলে যেতে বলি আর ওকে অবজারভেশনের জন্য রেখে দিই।" 

"আমার ডিউটি শেষ বাড়িতে ফিরবো এবার তাই বেরোবার আগে মেয়েটাকে একবার দেখতে গেলাম।  দেখলাম চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে  ,আর কোন ভয় নেই দেখে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে আসছি হঠাৎ মেয়েটা আমার হাতটা ধরে  কাঁদতে লাগলো ,বলল কেন আমাকে বাঁচালেন"। 

"আমি বললাম চুপ করো এইভাবে নিজেকে নিজে হারিয়ে কি লাভ,তার থেকে তোমাকে উপযুক্ত জবাব দিতে হবে তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার কথা ভাবো। মেয়েটা আরও কাঁদতে লাগলো, আমি বললাম কাঁদছো কেন তুমি তো ভীষন অন্যায় কাজ করেছ। একবার ও চিন্তা করো নি তোমার কিছু হয়ে গেলে তোমার মা, বাবা কি করতেন।
 
 মেয়েটি বলল ম্যডাম মা, বাবা স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার সময় আমাকে ছেড়ে ছমাসের ব্যবধানে দুজেনেই চলে গেছে না ফেরার দেশে। আমি বললাম খুব কষ্টের জানি তবু কিছু জিনিস মেনে নিতে হয়,তোমাকেও তো নিজের জন্য ভালো থাকতে হবে।মেয়েটি বলল আমার কথা শুনলে আপনি আর বলবেন না ভালো থাকার কথা।আমি বললাম শুনি তোমার কথা বলো আসলে আমি মেয়েটার মনের বোঝা হাল্কা করতে চাইছিলাম "।
 
  "বলল শুনবেন ?,আমি হ্যাঁ বলে ওর খাটের পাশে বসলাম । মেয়েটা বলতে শুরু করল  "মা,বাবা নেই সেই সুযোগে  আমার কাকা , কাকিমা সম্পত্তি দখল করার জন্য গ্রাম থেকে শহরে চলে আসেন খবর পেয়ে  । ঠাকুমার জন্য পারেননি কিছু করতে, ওনারা  অনেক ঝামেলা করেও, তারপর আমি হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে কলেজে ভর্তি হলাম "। 
  
"কাকা,কাকিমা কিছুতেই পড়তে আমাকে দেবেন না। ঠাকুমা ওদের কে এখান থেকে চলে যেতে বললেন, ঠাকুমা বললেন ওর বাবার ইচ্ছে ছিলো তাঁর মেয়ে লেখাপড়া শিখবে তাই তোমরা কেউ বাঁধা দেবে না। কদিন কাকা খুব অশান্তি করলো,আমার বাড়ির বাইরে যাওয়া নিয়ে । এতো বড় মেয়েকে এরপর কি করে বিয়ে দেবে,সমাজ কি বলবে । ঠাকুমা বললেন আমার দিদিভাই আগে লেখাপড়া শিখুক তারপর বিয়ের কথা ভাবা যাবে । কাকা ,কাকিমা ঠাকুরমার কাছে না পেরে ফিরে গেলেন" । 
 
"আমাদের পাশের বাড়ি বিজনদের ,ছোটবেলায় একসঙ্গে খেলেছি,যদিও বিজন অনেকটাই বড় আমার থেকে তবুও  ওর সঙ্গে আমার আলাদা সম্পর্ক ছিল । দুজনেই বুঝতাম, বিজনদের বাড়িতে আমার যাওয়া আসা ছিল। বিজনের মা বোস কাকিমা আমাকে মেয়ের মতো ভালবাসতেন। বিজনের বাবার চেষ্টাতে আমি আমার বাবার টাকাগুলো বাঁচাতে পেরেছি কাকাদের হাত থেকে"।

"যাইহোক আমার কপাল এমন খারাপ কলেজে প্রথমবর্ষের পরীক্ষা শেষ হলো ঠিক তখনই ঠাকুমা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন । এবার কাকা,কাকিমা স্বাধীন আমার কোন কথা না শুনে আমাদের বাড়ি বিক্রি করে সেইটাকা ,জিনিসপত্র, মায়ের গয়না সব নিজেরা নিয়ে আমার পড়াশোনার কথা গাহ্য না করে গ্রামে এনে তুললেন আমাকে জোর করে ,আমি হাতপায়ে ধরে কাকাদের কাছে কেঁদে ছিলাম কোন কথা শোনেননি "। 

"খালি  আসার আগে বিজন আমাকে বলেছিল  ঠিকানা দিয়ে যাস আমি তোকে লুকিয়ে নিয়ে চলে আসবো ভাবিস না  ।আমার চাকরিটা আর একমাস হোক ।আমি গ্রামে গিয়ে জানো দিদি মানতে পারতাম না । ভাবতাম এতো খারাপ কপাল কারুর  হয়। শুধু আশায় থাকতাম বিজন কখন আসবে। এদিকে কাকারা আমার বিয়ে ঠিক করেছে,কি অসহ্য সব মানুষ খালি বলতো  এতো বড় মেয়ে এখনও বিয়ে হয়নি"।
"তোমাদের বংশের কলঙ্ক গো,তাড়াতাড়ি যাকে পাও তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দাও"। "জানো আনন্দ আমি ওর খাটের পাশে বসে ওর গল্প শুনছিলাম এতো গভীরভাবে বাড়িতে ফিরতে হবে সেটাই  ভুলে গেছি, আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল মেয়েটার কথা শুনে" । "মেয়েটির নাম লাবণ্য ওর ঠাকুমা রেখেছিল নাম ।আমি শুনে বলেছিলাম নামটি যথাযথ, তোমার মতই সুন্দর নাম"। 

মেয়েটা বলল "জানেন বিয়ের  সাতদিন আগে একটা বাচ্চা ছেলে চুপিচুপি বলল আপনাকে ডাকছেন একজন শহরের মানুষ ,উনি বড় রাস্তায়  দাঁড়িয়ে আছেন।" "আমি বললাম ভাই আমাকে নিয়ে যাবি আমি তো চিনি না এখানকার রাস্তা "। ছেলেটা বলল "দিদি তুমি ফাঁক পেলেই বেড়িয়ে এসো আমি কাছেই থাকবো" ।" 
"কাকিমা পুকুরে চান করতে গেছেন, কাকা ছিল না, আমি কাকার ছেলেমেয়েদের লুকিয়ে ছুটতে থাকি কাকার বাড়ী থেকে , তখন ওই বাচ্চা ছেলেটা "আমাকে বলে দিদি এইদিকে চল ফাঁকায় মাঠের ধারে ধারে । ছেলেটা বুঝতে পেরেছিল আমি অভ্যস্ত নয় এইসব রাস্তায় চলতে তাই পরমযন্তে হাত ধরে আমাকে বিজনের কাছে পৌঁচ্ছে দিয়েছিল । আমি বিজনের গাড়িতে উঠার সময় ছেলেটিকে আদর করে বললাম ভালো থাকিস ভাই "। 

"এরপর বিজন আমাকে এক মন্দিরে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করল। মাস দুয়েক স্বামী, স্ত্রী মতো থাকলাম বেশ আনন্দে ।ভাবতাম এতো ভালবাসা আমার কপালে লেখা আছে আসলে সবটাই যে ফাঁকি তা বুঝতে পারিনি । তারপর একদিন বিজন ওদের বাড়িতে গেল দরকার আছে বলে। ওই বিদেশ বিভুঁয়ে আমি একা থাকলাম ভয়ে ভয়ে । তারপর ফিরে এসে বিজন আমাকে বলল খুব কষ্ট হয়েছে তোমার বুঝতে পেরেছি কি করবো মা,বাবা জানে না আমি বিয়ে করেছি উনাদের সুযোগ পেলে বলবো তখন তোমাকে নিয়ে যাবো, আমি বিশ্বাস করেছিলাম ওর কথা"। 
"কিন্তু  পরেরদিনই বলল লাবণ্য তোমার পড়ার ইচ্ছে নাই", আমি বললাম "খুব মন খারাপ হয় পড়াশোনাটা শেষ করতে পারলাম না বলে" । তখন বিজন বলল "তোমাকে না বলে আমি কলকাতায় গিয়ে এবার তোমার হোষ্টেলে থাকার বন্দবস্তো করে এসেছি কালকেই তোমাকে দিয়ে আসবো" । "আমি বললাম আমি চলে গেলে তোমার অসুবিধা হবে তো ,আর তোমাকে ছেড়ে থাকবো কি করে"। 
 
বিজন বলল "মনখারাপ নয় পড়াশোনা আগে শেষ করতে হবে তারপর তো সারাজীবন একসঙ্গে থাকবো আমরা"। "আমাকে হোষ্টেলে দিয়ে এরপর জানেন দুমাস ওর আর কোন খোঁজ নেই ওর অফিসে খোঁজ  করে জানি অন্য জায়গায় বদলি হয়ে চলে গেছে "। "এদিকে আমার শরীর খারাপ, মন বলছে আমি প্রেগনেন্ট । তাই আমি বিজনদের বাড়িতে গিয়ে ওর মাকে সব বলবো বলে যাই কিন্তু তখনই   দেখি ওদের বাড়িতে প্যান্ডেল,হতবাক হয়ে না ঢুকে  রাস্তায় একপাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম ।কিছুক্ষণ পর দেখলাম বিজন গাড়ি  বিয়ে করতে যাচ্ছে" । 
"এরপর এই জীবন রাখার কোন প্রয়োজন আছে, আমি কি  করবো বেঁচে থেকে বলতে পারেন ।কি করে লড়বো বিশ্বাসঘাতকের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নেই আমার কাছে" । 

"জানো আনন্দ মেয়েটার কান্না দেখে আমারও চোখে জল আমি বুঝতে পেরেছিলাম ও গর্ভবতী কিন্তু যে পয়জেন ও খেয়েছে তাতে ওর বাচ্চার ক্ষতি তো হবেই"। আমি ওর হাতটা ধরে বললাম "তোমার পড়াশোনা শিখে কি হওয়ার ইচ্ছে।"
 লাবণ্য বলল "আমার বাবা এডভোকেট ছিলেন আমারও তাই ইচ্ছা" । আমি বললাম "আমি তোমাকে সবরকম সাহায্য করবো তবে তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে" । আমি বললাম "মনোবল হারালে চলবে না ,মনকে শক্ত করো একার লড়াই একাই লড়বে আর তোমার এই দিদি আছে তোমার সঙ্গে" । 
  আমি বললাম  "আনন্দ তোমার কথা বললাম  ভবিষ্যতে তুমি ওকে সাহায্য করতে পারবে" । লাবণ্য বলল "কিন্তু দিদি এই সমস্যা কি করবো?" ।আমি বললাম "এখন সাতদিন রেষ্ট নাও তারপর হোষ্টেলে বলে আসবে আমার দিদির বাড়িতে যাবো" । ওকে বললাম "তোমার বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে ওকে শরীর থেকে বার করতে হবে ।আজকে সোমবার পরের সোমবার কিছু না খেয়ে চলে আসবে তারপর যা ব্যাবস্থা করার আমিই করবো"।
  
  "তারপর আনন্দ ওকে সুস্থ করে  আমি নিজে ওকে হোষ্টেলে পৌঁচ্ছে দিয়েছি। এখনও মন দিয়ে পড়াশোনা করছে মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে দেখা করে যায় । সামনে মাসে ওর ফাইনাল পরীক্ষা, ওকালতি পড়বে বলে সব যোগাযোগ করে রেখেছে, রেজাল্ট বেরোলেই ও ভর্তি হবে । তবে তার থেকেও ভালো খবর ও গভর্নমেন্টর ব্লক ডেভলপমেন্ট অফিসার পদের  লিখিত পরীক্ষায়  পাস করেছে" ।
  
 "ওকে আমি কয়েকদিন আমাদের বাড়িতে রেখে কিছু বইপত্র এনে পড়াশোনায়  সাহায্য করেছিলাম, লাবণ্য মেধাবী মেয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ ঠিক করতে পারবে আমি জানি তাই পাশে থাকার চেষ্টা করছি।" লাবণ্য আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল "কি করবে চাকরি করবে না পড়াশোনাটা চালিয়ে যাবে "। আমি ওকে বলেছি চাকরি করেও পড়া যায় । আর তুমি যে চাকরিটা পেয়েছো এটা খুব সম্মানের চাকরি, অনেক উন্নতি করতে পারবে চেষ্টা করলে। আর এই চাকরির দরজা খুব অল্প দিন মেয়েদের জন্য খুলেছে। তুমিই হয়তো প্রথম মেয়েদের একজন " । সুতরাং রেডি হও আগামী পরীক্ষায় তুমি সফল হয়ে অফিসার পদে যোগদান করবে"। লাবণ্য আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল "দিদি এই দুনিয়ার আপন বলতে একমাত্র তুমি আছো আমার তাই তোমার কথা রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করবো আমি তুমি আমাকে আশীর্বাদ করো"
** চলবে **





Comments

Popular posts from this blog

আমার স্বপ্নের ঘর

মল্লিকাঅর্জুন ( চতুর্থ পর্ব)

আমি সেই মেয়েটা