একটি মেয়ের উত্তরণের গল্প (৪র্থ,৫ম,৬ষ্ঠ পর্ব)
** একটি মেয়ের উত্তরণের গল্প ( ৪র্থ পর্ব)**
এরপর কয়েকমাস কেটে গেছে, আমার শরীরে এমনি কোন অসুবিধা নেই তবে ভেতরের জন বড় হচ্ছিল তাই চলাফেরা করতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল । আমার খবর পাবার পর আনন্দের মা ,বাবা চলে এসেছেন । আনন্দের বাবা একজন ডাক্তার উনি তো আবার একটু বেশি খেয়াল রাখেন ।
সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় আনন্দের মা ,যাকে আমার ভীষণ রাসভারী মহিলা মনে হতো এখন উনাকে দেখে কেউ বলবেন না উনি আমার নিজের মা নন। আমার পড়াশোনায় উনার কোন আপত্তি নেই বরং আমাকে উৎসাহ দিয়ে বলেন "বৌমা আমরা তো জানতেই পারিনি মেয়েরাও অনেককিছু সমাজকে দিতে পারে, তাঁরা পুরুষদের সমকক্ষ হয়ে নিজের মতো করে বাঁচতে পারে" ।
"আমরা জেনেছিলাম মেয়েদের হেঁসেল ঠেলা,বাচ্চা মানুষ করা আর স্বামী সহ শ্বশুরবাড়ির লোকদের মন জুগিয়ে চলতে হবে সেইমত জীবন পার করেদিলাম।খোকা আমার চোখ খুলে দিয়েছে,তোমার স্কুলের অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখেছিলাম নতুন যুগের মেয়েদের, কত স্বচ্ছন্দবোধ তাদের সংস্কার ও সংস্কৃতিকে নিয়ে সঙ্গে চলায়,কত উদার তাঁরা । আমাদের মতো কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে একটা মেয়ে আরেকটা মেয়েকে গন্ডি দেয়নি বরং তোমাদের দিদিমণিরা কত উদার মানসিকতা তাদের ভাষণে বুঝেছিলাম ।তোমার দিদিমণিদের জন্য ছোট ছোট মেয়েরা শিক্ষার সঙ্গে কতকিছু শিখতে পারছে স্কুলে ।সেদিন তোমাদের নৃত্যনাট্যে দেখে আমি অভিভূত হয়েছিলাম । আমার বৌমার জন্য আমার গর্ব হচ্ছিল, সেদিন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যাহোক আমি তোমার লেখাপড়ার পাশে থাকবোই"। আমি আনন্দের মাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম আর বলেছিলাম "মা শুধু আপনি উনার(আনন্দের) মা নন আমারও মা,অনেক জন্মের পূর্ণ ফলে আমি আপনাদের পেয়েছি।
আমার প্রথম বর্ষের পরীক্ষার সময় আমি একটু রাত জেগে পড়াশোনা করতাম । মা মাঝরাতে উঠে আমাকে দুধ গরম করে এনে খাওয়াতেন জোর করে ,বলতেন "অনেকক্ষণ আগে খেয়েছো বৌমা দুধটা খেয়ে এবার ঘুমিয়ে পরো"। আমার ভীষণ সংকোচ হতো মা অত রাত অবধি জেগে থাকতেন বলে।
মাকে বললেও শুনতেন না বলতেন "এইটুকু একটা বাচ্চা মেয়ে তুমি এতো কষ্ট করছো আর আমি এইটুকু পারবো না" ।
আমার পরীক্ষা শেষ হবার সাতদিন পর আমার একটা ছেলে হলো । রমেশ ঠাকুরপো জন্য কোন অসুবিধা হয়নি উনি সবসময় মা,বাবার পাশে ছিলেন । আমি হাসপাতাল থেকে কয়েকদিন পর ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে ফিরলাম,মা,বাবা খুব খুশী, কিন্তু আমার মনে দুশ্চিন্তার মেঘ।এই কমাসে মাত্র গোটা তিনেক চিঠি এসেছে আনন্দের । তবে আনন্দ কোন চিঠিতেই ওর বাবা হবার উচ্ছাস প্রকাশ করেনি।এমনকি আমার শরীরের কথা জানতে চাইনি শুধু মন দিয়ে পড়াশোনার কথা লিখেছেন । আমি যে আনন্দকে চিনেছি যার জন্য আমি বাঁচতে শিখেছি নতুনভাবে সেই আনন্দকে চিঠির মধ্যে খুঁজে পাইনা। আনন্দ যেন সত্যি করেই আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছে । মন খারাপ মধ্যে সবার সঙ্গে অভিনয় করে যাই আমি ভালো আছি বলে ।
আত্মীয় স্বজনেরা সবাই দেখতে এসেছেন আমাদের সন্তানকে ।আমার মা,বাবা ও এসেছিলেন, কেউ বলেন "ছেলে আনন্দের মতো দেখতে ,কেউ বলেন
আমার মতো দেখতে" । আমি ভাবি ওর কপালের কথা ওর কি বাবার ভালবাসা জুটবে না । আমার শ্বাশুড়ীমা লোক রাখলেও ছেলের সব ঝামেলা নিজে সামলান । কিন্তু ছেলে আমার এইটুকু বয়েস থেকে তার মাকে চেনে। আমার কোলে এলেই সে চুপ করে খেলা করে নয় ঘুমায়। শ্বাশুড়ীমা বলেন "বৌমা অভ্যাস করো না একমাস পর তোমার কলেজ শুরু হলে তখন ওকে রাখা মুশকিল হবে"।আমার গোপালের হাসি দেখতে,আর ওর সাথে কথা বলতে বেশ লাগে যদি জানি ও কিছুই বোঝে না ,আমি গোপালকে ওর বাবার গল্প বলি ,বলি "ওই দেবতার মত মানুষটাকে পেয়েছিলাম বলে আমার জীবন আজ অন্যরকম " ।
রমেশ ঠাকুরপো মাঝেমধ্যে ছেলেকে দেখে যান ,আমার মনে হয় আমার গোপাল উনাকে মায়ার বাঁধনে জড়িয়েছে।দেখতে দেখতে ছেলের ছমাস হয়ে গেল এবার ওর অন্নপ্রাশন, আমার শ্বাশুড়ীমা ও শ্বশুরমশাইয়ের ভীষণ উৎসাহ তাদের প্রথম নাতির অন্নপ্রাশন নিয়ে ।আমার মনটা ভালো লাগছে না আনন্দযজ্ঞে সামিল হতে আনন্দকে ছাড়া ।তবুও মায়ের এতো আনন্দকে আমি মলিন করতে পারিনা বা উচিত নয় তাই চুপচাপ আছি । কি জানি মায়েরা বোধহয় অন্তযার্মী হয় তাই আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন "বৌমা ভেবোনা তোমার বাবা মেল করেছেন আনন্দকে আসবার জন্য ,আনন্দ জবাব দিয়েছে দুদিন আগেই আসবে"।
আমার ভীষণ আনন্দ হলো শুনে ,আমার ছেলের মা নাম রেখেছেন অরিন্দম, বাবা ডাকেন রাজা বলে । আমার কাছে সে গোপাল ,তাই গোপালকে চুপিচুপি জানিয়ে রাখলাম "তার বাবা আসছে বলে,তার অনেক আদর পাওনা থেকে সে বঞ্চিত ছিল এবার সুদে আসলে সবটাই যেন সে আদায় করে নেয়"।
আমার পরীক্ষা ছিল শেষ হয়ে গেছে আমি স্যারদের থেকে কয়েকদিনের ছুটি চেয়ে নিয়েছি। বাবা একসপ্তাহ আগেই চলে গেছেন সবকিছু জোগাড় করতে, নিমন্ত্রণ সারতে ,যদিও কাকারা এসেছিলেন বাবা উনাদেরকে সব বুঝিয়ে দিয়েছেন,আনন্দের দিদিদের আনার ব্যবস্থা করতে ।
সেদিন আমি স্নান সেরে ছাদের উপর চুল খুলে দাঁড়িয়ে আছি কখন আনন্দ আসবে, সেসময় আমি শুনলাম "বিনু তুমি কোথায়", এই গলার স্বর শোনার জন্য আমি এতোদিন প্রতীক্ষায় ছিলাম ।পারলাম না নিজেকে সামলাতে আমি ছুটে ঝাঁপিয়ে পরলাম উনার বুকের উপর ।উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন "আমার বিনু বড় হয়ে গেছে বুঝতে পারছি "। আমি চুপ করে থাকলাম, উনি আমার মুখটি তুলে "খুব কষ্ট বুঝতে পারছি, আমারও তো হয়েছে বিনু তোমাকে ছেড়ে থাকতে" । তারপর উনি বললেন "চল আমাদের খোকার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে তার বাবার" । আমি বললাম "খোকাকে দেখোনি এখনও", উনি বললেন "আমি মাকে প্রনাম করেই উপরে চলে এসেছি"। আমি বললাম "চলো গোপালের কাছে"। আনন্দ বলল "আমি স্নান সেরে যাচ্ছি তুমি একটু অপেক্ষা করো",কিছুক্ষণ পর আমি আর আনন্দকে নিয়ে গোপালের কাছে গেলাম । আনন্দ গোপালকে কোলে নিতে আনন্দের দেখি চোখ দুটো ছলছল করছে, আমি বললাম "দেখো গোপাল ঠিক তাঁর বাবাকে চিনতে পেরে চুপ করে আছে"। আনন্দ বলল "আমি তো খোকার আসার খবরই পাইনি কদিন আগে রমেশের চিঠিতে জানলাম আমি পুত্রের বাবা হয়েছি, তারপর বাবার মেল পেলাম ছেলের অন্নপ্রাশন আমাকে অবশ্যই আসতে হবে"।
আমি বললাম "সেকি আমি তো পরপর কয়েকটি চিঠিতে তোমাকে সব লিখেছিলাম", আনন্দ বলল "তোমার একটাও চিঠি পাইনি তাই তো খুব অভিমান হয়েছিল । মনখারাপ হতো ভাবতাম আমার বিনুও আমাকে ভুলে গেল"।আমি বললাম "তোমার ভাবনা যে ভুল ছিল এখন বুঝতে পারছো তো"। আনন্দ বলল "বিনু তুমি বুঝবে না পরবাসে সবাইকে ছেড়ে কি প্রচণ্ড মন খারাপ হয়,দুশ্চিন্তা হয়। তখন ভালো থাকার একমাত্র অবলম্বন তোমাদের সবার চিঠি। সেখানে মায়ের একটা চিঠি যাবার পর পেয়েছিলাম, তোমার একটাও চিঠি পাইনি"।
আমি বললাম "কি আশ্চর্য আমি সময় পেলেই তোমাকে চিঠি লিখতাম সব খবর দিয়ে । তারপর সেগুলোএকসাথে করে গনেশদাদা দিতাম তোমাকে পাঠাতে। তাতে আমার অভিমান, আমার তোমাকে ছেড়ে থাকার কষ্ট, আমার রোজের দিনের গল্প থাকতো । একটাও তুমি পেলে না" । আনন্দ বলল "সাত সমুদ্র ওপারে তো আমি থাকি হয়তো একদিন পাবো"। আমি বললাম "এবার আমি রমেশ ঠাকুরপোর কাছে শিখে নেবো কেমন করে বিদেশে চিঠি পাঠাতে হয়,তাহলে আমি নিজেই পারবো তোমাকে চিঠি পাঠাতে অত ভাবতে হবে না তোমাকে আর" ।
আনন্দ বলল "এইজন্য তো বিনু আমি তোমার লেখাপড়ার শেখার জন্য এতজোর করেছি যাতে তুমি সবকাজে স্বাবলম্বী হও,সামান্য কিছুর জন্য পরমুখাপেক্ষি হয়ে না থাকো। শিক্ষা মানুষকে বিভ্রান্ত করে না বরং চলার রাস্তা সহজ করে দেয়। তুমি পড়ে যাও বিনু ,আমি জানি মেয়েদের ভগবান আলাদা ক্ষমতা দেন তাঁরা সংসার, সন্তান সব সামলিয়ে নিজের গন্তব্যে ঠিক পৌঁচ্ছাবে । তুমি পারবে খোকাকে সামলিয়ে তোমার ডাক্তারি পড়া সম্পূর্ণ করতে। আমার একটাই দুঃখ এইসময় কিছুদিন আমি তোমার পাশে থাকতে পারবো না তবে আমার সমর্থন সবসময় পাবে তুমি" ।
(৫)
আমরা গ্রামের বাড়িতে ছেলের অন্নপ্রাশন উপলক্ষে এসে পৌঁচ্ছেছি, মা তো খুব খুশী আমাদের সবাইকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পেরে। কতদিন পর তার ছেলে এসেছে, সঙ্গে নাতি । মায়ের খুশী বাড়িতে পা রেখেই বোঝা যাচ্ছে । মায়ের ইচ্ছেতে গোটা বাড়িতে লাইটের আলোয় ঝলমল করছে।
আনন্দের পিসিরা আমি প্রনাম করতেই পড়ুয়া বৌমা বলে ব্যঙ্গ করলেন ,আমি হেসে এড়িয়ে গেলাম উনাদের কথা । রাঙাদিদি এসে জড়িয়ে ধরে বললেন "ছোট্ট বিনোদিনী দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল, এখন আবার ছেলের কোলে নিয়ে যেন গিন্নি গিন্নি লাগছে । আমি বললাম "রাঙাদিদি এই নাও আমার গোপালকে ,আমার গোপাল কদিন একটু পিসির আদরের স্বাদ পাক"।রাঙাদিদি গোপালকে কোলে নিয়ে বললেন "ভারী লক্ষী ছেলে হয়েছে তোর বিনোদিনী একটু কান্নাকাটি নেই"। এমন সময় মা এসে ডাকলেন "বৌমা আমার ঘরে একবার আসবে তো"। আমি যেতে মা আমাকে এক বাক্স গয়না দিয়ে বললেন "এগুলো সব পরে নাও"। আমি বললাম "মা ! আপনার কাছে এখন থাকুক অনুষ্ঠানের সময় না হয় পরবো। এতো গয়না পরে আমি আমার গোপালকে সামলাতে পারবো না" । মা বললেন "মাগো আমার কি ভালো লাগে আমার একমাত্র ছেলের বৌ এইরকম সাজসজ্জা হীন হয়ে ঘুরছে বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজনের সামনে " । আমি বললাম "ঠিক আছে মা কালকে আপনার কথা মত আমি সাজবো আজকের দিনটা ছেড়ে দিন।
আমি যাই গোপালের ঘুমানোর সময় হয়েছে ওকে খাইয়ে দিই"। মা বললেন "অন্নপ্রাশনেও কিন্তু বৌমা অনেককিছু আচার নিয়ম আছে ,গায়ে হলুদ, বিয়ের মত অনেক কিছু" । আমি হেসে বললাম "তাহলে কনে জোগাড় করলেই ভালো হতো তো মা একবারে কাজ সারা হয়ে থাকত"।আমার কথা শুনে মা হাসতে হাসতে বললেন "অত সহজে ছুটি নেই বৌমা, ধাপে ধাপে সব অধ্যায়ে নিপুণ ভাবে দায়িত্ব আর কর্তব্য করে যেতে হবে । এটাই তো মা,বাবার কর্তব্য" । আমি বললাম "মা কেন করবে একা ,আমার গোপালের ঠাকুমা তাঁর নাতির অন্নপ্রাশন নিজের মনের মত করে করবে আমি সঙ্গে থাকবো অবশ্যই"।
মা বললেন "জানো বৌমা তুমি যখন আমাদের বাড়িতে প্রথম এলে বৌ হয়ে তখন আমার একটাই চিন্তা ছিল সংসারের নিয়ম কানুন তোমাকে কত তাড়াতাড়ি শেখাবো। সেটা যদি হতো বৌমা এখন ভাবি কত অন্যায় হতো। একটা মেয়েকে সংসারের রঙ্গমঞ্চে নিজের সমস্ত দুঃখ কষ্ট লুকিয়ে অভিনয় করে যেতে হতো । আজকের যে তুমি, একটা সাধারণ মেয়ের থেকে মেধাবী মেয়ের প্রকাশ হতো না" । আমি বললাম মা আপনার ছেলে, আপনি, বাবা সবাই মিলেই তো আমার এই উত্তরণের কান্ডারী "।
"আপনারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আমাকে সহযোগিতা করেছেন বলেই আমি নতুন এক দিগন্ত পেলাম। যে পথে হাঁটলে আমি স্বপ্ন দেখতে শিখব,তাকে সফল করতে আমার প্রচেষ্টা থাকবে অবিরত"।
মা বললেন "আমি সবসময় বৌমা তোমার পাশে আছি, আমার নিজের জীবন, আমার মেয়েদের জীবন আর লেখাপড়া শেখা মেয়েদের জীবনের পার্থক্য বুঝতে পারি এখন । কতটুকু জ্ঞান বলতো আমাদের ,বাইরের জগতের খবর তো কিছু জানি না। কুসংস্কার আমাদেরকে দিয়েছে অজ্ঞতা আর পরশ্রীকাতরতা। আমরা একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের জীবনকে আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে দিই সংস্কারের নামে শৃংখলের বেড়ি"।
আমি বললাম "মা আপনার মত প্রতিটি ঘরে মায়েদের যখন এইরকম মানসিকতার পরিবর্তন হবে তখন মেয়েদের আর সংস্কারের বেড়াজালে বন্দী থাকতে হবে না ,নিজেদের মুক্তির আলোকিত হয়ে সমাজ , সংসার সবকিছিকে আলোকিত করবে"।
পরেরদিন মায়ের ইচ্ছে অনুযায়ী আমাকে সাজতে হয়েছে। এতো গয়না আর বেনারসী পরে সেই বিয়ের কনের মত আমার অবস্থা । গ্রামে রটে গেছে আমি ডাক্তারী পড়ি তারজন্য কত মানুষের কত রকমের প্রশ্ন আমাকে । কেউ আমাকে প্রশ্ন করছেন "আমি বাইরের পুরুষ মানুষদের সামনে ঘোমটা খুলে থাকি-- না মানি ঘোমটা দিয়েই থাকি" ,আমি মনে মনে ভাবছি এরা যদি জানে পড়াশোনা আমাকে অনেক স্বাধীনতা দিয়েছে ভাবতে শিখিয়েছে সংস্কার আগলে রেখে পরিস্থিতি অনুযায়ী তাঁর ব্যবহার করতে । আমাকে নানারকম প্রশ্নের অস্বস্তিতে পড়তে দেখে শ্বাশুড়ীমা এগিয়ে এসে সব সামলাচ্ছেন, উত্তর দিচ্ছিলেন মিষ্টি করে। আনন্দ একবার চুপিচুপি বলে গেল "কোনকিছুর উত্তর না দিতে"।
আমার শ্বশুরমশাই তাঁর নাতির অন্নপ্রাশন উপলক্ষে গোটা গ্রামের মানুষকে নিমন্ত্রণ করেছেন । বিরাট এলাহী আয়োজন, ইতিমধ্যে আমার, মা ,বাবা, দাদা, বৌদিরা সবাই এসে গেছেন ।আমার গোপালের আবার রমেশ ঠাকুরপোর সঙ্গে বেজায় ভাব তাই তাঁর কোলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ।
তারপর বারোটার পর শুভলগ্নে আমার দাদা গোপালকে ভাত খাওয়ালেন । সমস্ত গ্রামের লোক একবার গোপালকে দেখতে চাইছেন । গোপালের বাবা ও দাদু গোপালকে দেখিয়ে আমাকে দিলেন, তখন আমার গোপালের দুচোখে ঘুম জড়িয়ে । আমি গোপালকে ঘুম পারিয়ে রাঙাদিদির কাছে রেখে এসে আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে কথা বলছি,যদিও আমার অত মনে নেই কে কি হোন ,সেসব মা সব বলে দিচ্ছেন । বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত খাওয়া দাওয়ার ঝামেলা চলল । আমার বাড়ির লোকরা চলে গেলেন ,আমার মা একবার আমাদের বাড়িতে আমাদের পাঠাতে শ্বাশুড়ীমাকে বলে গেলেন । মা ,বাবা চলে যেতে মনটা খারাপ হয়ে গেল কতদিন বাড়িতে যাইনি আমি । যাহোক শ্বাশুড়ীমার নির্দেশ আত্মীয় স্বজন থাকা অবধি গয়না খোলা যাবে না । আমাকে সাজিয়ে আমার শ্বাশুড়ীমার নাকি গর্ব হচ্ছিল এইরকম সুন্দরী, লেখাপড়া শেখা ,সহবত জানা বৌমার জন্য ।
রাতে যখন গোপাল ঘুমিয়ে পরেছে ,আমি সব লৌকিকতা সেরে ঘরে ডুকে পোশাক বদলাতে গেছি আনন্দ বলল "না তুমি এইরকম সেজে থাকো। আমাদের ফুলসজ্জার দিন তুমি ঘুমিয়ে পরেছিলে আজ সারারাত আমরা গল্প করবো" । আমি বললাম "বেশ তাই হবে ", আমি আনন্দের বাহুডরে গত বিচ্ছেদের সময়ের আমার যত গল্প জমা ছিল তাই বলে গেলাম । সারারাত আনন্দের ভালবাসায় ভেসে হারিয়ে গেলাম নব আনন্দের জোয়ারে ।
গোপালকে মামাবাড়ির ভাত খাইয়ে সব আচার অনুষ্ঠান শেষে আমরা এক সপ্তাহ পর কলকাতায় ফিরে এলাম । আমার কলেজ কদিন ছুটি ছিল বিভিন্ন ছুটির জন্য,তাছাড়া আনন্দকে একা ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছিল না । আমার গোপাল এখন তাঁর বাবাকে চিনে গেছে, বেশ ভাব দুজনের যতই হোক বাবা বলে কথা । আনন্দ "এক একেকবার নিজেকে অপরাধী বলছে ,ওর ধারণা আমার উপর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে ও। আমাকে ছেলেকে সামলিয়ে ডাক্তারী পড়ার মত কঠিন পড়া চালিয়ে যেতে হচ্ছে" । আমি আনন্দকে বোঝাই "গোপাল আমার জীবনে না এলে আমি তোমাকে ছেড়ে একাকী থাকতে পারতাম না । গোপাল আমার জীবনের পরমপ্রাপ্তি, ওর মুখটা দেখলে আমি সবকষ্ট ভুলে যাই"।
এরপর মা,বাবা এলেন আনন্দের যাবার আগের দিন, একটা দিন সবাই মিলে গল্প গুজব করে চলে গেল । পরেরদিন আবার আমাকে একা করে ব্যারিস্টারি পড়তে আনন্দ বিলেত চলে গেল । দুজনের চোখের জল বাঁধ মানছিল না, মনে হচ্ছিল ওকে আমার কাছে আটকে রেখে দিই। কিন্তু আমি পারলাম না ওর স্বপ্ন পূরণের বাধা হতে ,ওই দেবতার মত মানুষটার জন্য আমি মুক্তির স্বাদ পেয়েছি,আজকে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছি তাঁর স্বপ্ন পূরণ যাতে হয় সেই পথকে মসৃণ করাও আমার কর্তব্য।
(৬)
বেশ কয়েকবছর হয়ে গেল আনন্দের বিলেত যাওয়া, মাঝে দুবার ও এসেছে এই একবছর আসতে পারেননি তবে তাঁর কারণ বোঝাতে কয়েকপাতার চিঠি কয়েকটি এসেছে আমার কাছে। আমার চিঠি গুলোও পেয়েছে আনন্দ তবে জানিয়েছেন আমার চিঠি পড়লে সেদিন ওনার খুব মন খারাপ হয়ে যায় আমার আর আমার গোপালের জন্য । এখন বেশ বুঝতে পারছি আমার গোপাল তাঁর মনের অনেকটাই অংশ দখল করে নিয়েছে এটাই অবশ্য স্বাভাবিক । আনন্দের প্রতিটি চিঠিতে আমার প্রশংসা, আমি নাকি এতো ভালো চিঠি লিখি যে চিঠি বারবার পরেও তাঁর আশ মেটে না । আমাকে লেখাপড়ার সুযোগ না দিলে নাকি বিরাট অন্যায় হতো এক বিরল প্রতিভার অবলুপ্তি ঘটত । তাঁর অনুরোধ আমি যেন সুযোগ পেলেই তাকে একটা করে চিঠি লিখে রাখি তারপরে সময় মত ওগুলো পাঠিয়ে দিলেই হবে । আমার চিঠি তাঁর একাকী পরবাসে ভালো থাকার একমাত্র অবলম্বন । অগত্যা রাত্রিবেলায় যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে আমি তখন আমার মনে কথা ,আমার ভালবাসার কথা লেখার জন্য কলম ,কাগজ নিয়ে বসি ।
আমার গোপালের পাঁচ বছর বয়েস হয়ে গেছে তাকে স্কুলে ভর্তি করে এলাম আমি আর রমেশ ঠাকুরপো গিয়ে । গোপালকে আমি আমার জানার সর্বস্ব দিয়ে চার বছর বয়েস থেকে পড়াই। গোপাল খুব বাধ্য ও মেধাবী ছেলে। যার জন্য স্কুলে ভর্তিতে কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি। আমারও ডাক্তারি পড়া সম্পূর্ণ হয়েছে, আমি মেয়েদের চিকিত্সার বিশেষজ্ঞ হিসেবে যে পড়াশোনা দরকার সেটাও শেষ করেছি।
এখন আমি কলকাতার একটি হাসপাতালে চাকরি করি। এই চাকরি করতে গিয়ে আমার কত অভিজ্ঞতা হয়েছে আমাদের সমাজের অবক্ষয়ের তা বলার নয় । এখনও মেয়েদেরকে সন্তান জন্ম দেওয়া একমাত্র কাজ বলে মনে করা হয় । একটা মেয়ের শারীরিক ক্ষমতা নেই আর বাচ্চা জন্ম দেওয়ার কিন্তু বাড়ির লোক মানবেন না, প্রাণ হত্যা করা নাকি পাপ। অথচ মায়ের এই বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে জীবন বিপন্ন হতে পারে এই কথা তাদের বোঝান যায় না, উল্টে তাঁরা বলেন আমি নিজেকে দিকগজ ভাবছি, এইজন্যই মেয়েদের বেশি লেখাপড়া শেখান উচিত নয় মুখের উপর বলে অন্য ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে বলে চলে যায় । আমি চেষ্টা করি অসহায় মেয়েদের পাশে থাকতে ,তাদের যখন আলাদা করে দেখি সেইসময় বোঝাইও মেয়েদের।
ওদের সচেতন করার চেষ্টা করি আমি সবসময় । আমি মনে করি আমার এই লেখাপড়া শেখা গর্ব করে বলার জন্য নয় বরং মানুষকে সচেতন করে যদি মেয়েদের পাশে থাকার মানবিকতা বোধ আনতে পারি সেই চেষ্টা করা। মেয়েদের শিক্ষার ভীষণ দরকার এই মানসিকতা সমাজের কিছু মানুষের মধ্যেও যদি আনতে পারি তবে আমার শিক্ষা সফল হবে
আমি মনে করি । আমরা সবাই তো নিজের পরিবার, নিজের আত্মীয় স্বজনের গন্ডি মধ্যে আটকে থাকি সমস্ত চিন্তা ভাবনা নিয়ে, এর বাইরে আমরা ভাবিনা। আমার চেষ্টা মেয়েদের আরও বেশি করে শিক্ষার অঙ্গনে আনার,আমার বিশ্বাস শিক্ষায় পারে মানুষকে কুসংস্কার আর সংস্কারের পার্থক্যটা বোঝাতে ।
আমি কয়েকদিন ছুটি নিয়েছি মা,বাবা কয়েকদিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে গেছেন ।আমার গোপালের জন্য আমি বাড়িতে থাকলাম ,তাছাড়া ওকে আমার একদম ইদানিং সময় দেওয়া হচ্ছে না । আমার শ্বাশুড়ী মা না থাকলে গোপাল এমনিতেই মন খারাপ করে থাকে । গনেশদাদাকে তাহলে সারাদিন জ্বালিয়ে শেষ করবে।
আর ছমাস তারপর আনন্দ ফিরে আসবে তখন আমি খানিকটা দায়িত্ব মুক্ত হতে পারবো । মনটা ভালো লাগে না আনন্দকে ছেড়ে থাকতে । মনের কথার বলার মানুষটা না থাকলে বিষন্নতা গ্রাস করে কোন আনন্দই মনকে ছুঁতে পারে না ।সারাদিনের ব্যস্ততার শেষে দুজনে মুখোমুখি বসে মনের কথা শেয়ার করার মতো সুন্দর মূহুর্ত আর হতে পারে না ।
আজকে গোপাল ঘুমিয়ে যাবার পর বসলাম আনন্দকে মনের অঙ্গনে জমে থাকা কথা গুলো জানাতে । সুপ্রিয় --'--
আনন্দ
জানিনা তোমার ওখানে এখন কটা বাজছে, সময়ের তো আমাদের এখানকার থেকে বেশ ব্যবধান তাই আর হিসেবে না গিয়ে জানাই আজ আমার তোমার জন্য বড্ড মন খারাপ লাগছে । জানি না কেন এইরকম আজকে হচ্ছে । গোপাল ঘুমিয়ে পড়ার পর জানলায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম । খোলা আকাশের গায়ে আজকে চাঁদকে আমার মতো বড্ড একলা লাগছিল, হয়তো অল্প মেঘের উপস্থিতির জন্যই তারারা ছিল না । আবছা আলো নিয়ে চাঁদ যেন বলল মন খারাপ করো না তাহলে সে কষ্ট পাবে,জানো না মন খারাপ কখনও একার হয়না যত দূরে থাক ভালবাসার মানুষ তারও মন খারাপ হবে।পরস্পরের মন যখন একসঙ্গে বাঁধা পরে তখন অনুভূতিগুলো ও যে এক হয়। তাই আমি চোখের জল মুছে চাঁদকে কথা দিয়ে লিখতে বসলাম, হিজিবিজি মনের কথা যা শুধু তোমার জন্য ।
তুমি তো আমার সেই রূপকথার রাজপুত্তুর যাঁর সোনার মতো মনের ছোঁয়ায় আমার মেয়ে জন্ম সার্থক হয়েছে । তোমার বলিষ্ঠ চেতনা সমস্ত কুসংস্কার বিরুদ্ধে গিয়ে আমার অন্ধকার পথের আলোর দিশারী হয়েছে । আমার তখন বোধ ছিলনা মেয়েদেরও লেখার পড়ার শেখার অধিকার আছে,সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্ন মেয়েরাও দেখতে পারে ।
জ্ঞান হবার পর থেকে মা,ঠাকুমাকে যা দেখেছি আমার ভবিতব্য তাই হবে এটা ধরেই নিয়েছিলাম তাই কোন আক্ষেপ নয় বরং স্বর্ণ অলংকারে সুসজ্জিত হয়ে সানন্দে তোমাদের বাড়িতে এসেছিলাম । কিন্তু তুমি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলে, একটা ছোট্ট মেয়েকে কত সুমধুর সম্ভাষণে বোঝালে ওই মোটা মোটা বইয়ের মধ্যে কতকিছু জানার আছে,আমি অবাক হয়ে ভেবেছিলাম আমি কি পারবো কোনদিন জানতে, আবার ভেবেছিলাম নাই বা জানলাম কি আছে তাতে কি আর ক্ষতি হবে ।
তুমি আমার মনোভাব বুঝতে পেরেছিলে অন্তর্যামী হয়ে তাই প্রত্যেক রাতে আমাকে গল্প শোনাতে সেই মেয়েদের গল্প যাঁরা অন্তঃপুরের সব বাঁধা পেরিয়ে সমাজের বুকে নিজের নাম রেখে গেছেন। আমাকে বুঝিয়ে ছিলে সমাজ এই আচর - বিচারের নামে মেয়েদের শৃংখলে আবদ্ধ করে, কারণ মেয়েরা লেখাপড়া শিখে পুরুষের সমকক্ষ হলে যে পুরুষদের আত্মসম্মানে আঘাত লাগবে।তখন যে মেয়েদের উঠতে বললে উঠবে না,বসতে বললে বসবে না তাদের স্বাধীন একটা মতামত হবে। তাঁরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখবে।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তোমার কথাগুলোকে আত্মস্থ করেছিলাম, দেবতার পায়ে ফুল দিলে যেমন আত্মতৃপ্তি হয়ে আমি সেরকম নিজেকে তোমার কাছে সমর্পণ করেছিলাম। তোমাকে সম্মান জানাতে ভালবাসার অর্ঘ্য দিলাম পড়াশোনায় একাগ্র চিত্তে মনোনিবেশ করে। আমার ধ্যান জ্ঞান হলো তোমার মনের মতো রেজাল্ট করা। প্রত্যেকবার একটা ক্লাসে উঠতাম আরও ভালো রেজাল্ট করে, তারপর যখন তোমার হাসি দেখতাম মনে হতো আমার দেবতার পূজো সার্থক হয়েছে । আমি নিজে যতটা মুক্তির স্বাদ পেয়েছি তার থেকে বেশি তৃপ্তি পেতাম তোমাকে খুশি করতে পারার জন্য ।
আমার মতো সামান্য একটা মেয়েকে যে মানুষ স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্য শেখায় সেতো আমার কাছে ভগবান । আমি যখন কলেজের লাইব্রেরিতে বসে চার,পাঁচটা বই ঘেটে নোট তৈরি করতাম তখন একেক সময় ভাবতাম কত সহজেই তুমি আমাকে পৌঁচ্ছে দিয়েছো এইরকম ভাবনায় যা আমার কল্পনায় ও ছিলনা।
যাক আজকে আমার দেবতাকে একটা গল্প শোনাতে ইচ্ছে করছে, আমি আজকে যা করতে পারছি মানুষের জন্য সব তো তোমারই জন্য । আমার কাছে হাসপাতালে একটা মেয়ে এসেছে কয়েকদিন আগে আমার থেকে অনেক ছোট বয়েসে,মেয়েটির নাম শ্যামা । শ্যামার বর জুটমিলে কাজ করে । ওদের বাড়ি মানিকতলায় সেখানেই শ্বাশুড়ীমা, শ্বশুর মশাই, এক দেওর ও দুই ননদ থাকে । শ্বশুর মশাই কোর্টের মুহুরী আর দেশে কিছু জমিজমা আছে। বাবা আর ছেলের রোজগারে মোটামুটি সচ্ছল পরিবার ওরা। শ্যামার এর আগে দুবার বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে তাই শ্বাশুড়ীমা হুকুম জারি করেছেন এবার তার নাতি-নাতনি চাই তা নাহলে ছেলের আবার বিয়ে দেবেন ।
শ্যামার বর আবার শ্যামাকে খুব ভালবাসে সে আর বিয়ে করতে চাই না । শ্যামার বর শ্যামার সঙ্গে সারাজীবন থাকতে চাই তাই আমার কাছে হাত জোড় করে অনুরোধ করে আমি যেন শ্যামা মা হতে পারে তার সাহায্য করি ওদেরকে । শ্যামা কান্নাকাটি করে আমাকে বলছে "আমার কোথাও যাবার জায়গা নেই, ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো না" । আমি শ্যামাকে পরীক্ষা করে ও জিজ্ঞাসাবাদ করে যা বুঝলাম ----।
Comments
Post a Comment