একটি মেয়ের উত্তরণের গল্প
**একটি মেয়ের উত্তরণের গল্প ( প্রথম পর্ব)**
অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি মিষ্টি শীতের রোদ্দুরের
আমেজ সবে শুরু সেইসময় সানাইয়ের সুরে মেয়েটা পর গোত্র হয়েছিল কোন এক শুভ লগ্নে । তাঁর বোঝার মতো বয়েস ছিল না বিয়ের সারমর্ম তবুও সামাজিক দায়বদ্ধতা মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া সেই প্রথা মেনে বিনোদিনীর মা,বাবা বিনোদিনীর বিয়ের ব্যবস্থা করেন।
বিনোদিনী বাড়ির বড় আদরের তাঁর ঠাকুমা, দাদু,পরিবারের সকল সদস্যদের কাছে। বিনোদিনী বড় জ্যাঠার তিন ছেলে ,ছোট জ্যাঠারও দুই ছেলে,বিনোদিনীর দুই দাদা ,কাকারও দুই ছেলে । যৌথ পরিবারের একমাত্র কন্যা সন্তান বিনোদিনী ।
তাঁকে কাছ ছাড়া করতে পুরোনো ধ্যান ধারণায় বিশ্বাস করলেও স্নেহের বন্ধনের কাছে সবকিছু পরাজিত হয় তাই ঠাকুরমা উপযাচিত হয়ে সমন্ধ এলেও নাকচ করেছিলেন এখন নাতনির বিয়ে দেবেন না বলে ।
কিন্তু ছেলের বাড়ির পীড়াপীড়ি ও বিনোদিনী বাবার পিসিদের কথার বানে ঠাকুমা বিয়ের সম্মতি দেন। অবশেষে বিয়ের পরের দিন বিনোদিনীর বিদায়ের শুভ মূহূর্ত , বিনোদিনী অশ্রু ঝরিয়ে চলে গেল সবফেলে যা ছিল তার নিজের স্নেহ-অধিকার একান্তই ।বিনোদনী আজ নিরবে মেয়ে ধর্মপালন করিতে চলল যা পরম্পরায় চলে আসছে যুগযুগ ধরে।
কত জনপথ, কতপল্লিপথে ধূলি উড়িয়ে চলেছে সে, চক্ষু ছলছল করে বক্ষের কাছে পাষাণের ভার অবোধ কন্যার । তবুও তার মুখে বাক্য নেই অবাক বিস্ময়ে ভাবে কি হবে ,কেমন লোকজন সব এই পরবাসে , তাকে আপন করে নেবে তো তারা। নানা ভাবনা চিন্তায় বিনোদিনী মন খুব ভারাক্রান্ত । অবশেষে পৌঁচ্ছল বিশাল অট্টালিকার সামনে প্রায় সন্ধ্যা তখন ।অজানা অচেনা ঠিকানায়, তাঁর অভ্যর্থনা আয়োজনে একদন্ড তরে মনে হলো অভিষেক হচ্ছে রূপকথার গল্পের মতো সে যেন রাজরানি। যদিও সিংহাসন ছিল না তবুও মূহুর্তেরা সেজেছিল সানাইয়ের সুরে আভিজাত্যের মোড়কে । তারপর তাকে শেখানোর হলো আচরণ আর নিয়মের লম্বা ফিরিস্তির দোহায় ।
এটা ওটা আবশ্যিক যদি যুক্তির কথা, অনেক বাক্যব্যয়ে বোঝাই হইল উঁচু পর্বতের ন্যায় অলিখিত আইন যা বিনোদিনী মতো সদ্য কিশোরীর বোধ্যগম্য হয়নি। সেই বাড়ির আভিজাত্যের প্রতীক কি ,এছাড়া কত মঙ্গল- অমঙ্গলের কথা শুনে ভীতু মেয়ের বড় একলা লাগছিল অচেনা পরিবেশে । চেয়ে দেখতে পারিনি ফিরেও লোকের ভীড়ে প্রিয়র মুখ, নতশিরে দুটি চোখ হয়তো খুঁজেছিল একটা ভরসার আশ্রয় । যাহোক আচার নিয়ম শেষ হলে তাকে একটা বিরাট ঘরে এক পালঙ্কে বসিয়ে সবাই তার রূপের বিচার আর তার বাপের বাড়ির গয়নার পর্যবক্ষেণ করছিল। অনেক মহিলা সমাগম নানা কথায় দিশাহারা বিনোদিনী এই অভিজ্ঞতায় সে একদম নির্বাক ।
সেই মূহূর্তে বিনোদিনী পক্ষে বোঝা সম্ভবপর নয় কে কুটুম আর কে এই বাড়ির লোক । বেশ খানিকক্ষণ এইরকম চলার পর সম্পর্কে ননদিনী হয় সে উদ্বার করে তার সাজসজ্জা পরিবর্তন করে খাবার ব্যবস্থা করে। সেই ননদিনী বলেছিল তাকে রাঙা দিদি বলতে। এই রাঙাদিদি বিনোদিনীর শ্বশুরবাড়ির অচেনা পরিবেশের একমাত্র আশ্রয় হয় সেই মূহূর্তে । তারপর রাঙাদিদির কাছে সেইরাতে পরম মমতায় কাটায় বিনোদিনী রাজমহলে। পরেরদিন সকাল থেকে চলে আচার নিয়ম, ছোট্ট মেয়েটার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বুঝতে পারার মতো কেউ ছিল না । শ্বাশুড়ীমা ভীষণ রাসভারী মহিলা, গা ভর্তি গয়না দামি কাপড়ে সজ্জিত নিজেকে বোঝাতে চাইছেন এই রাজমহলের তিনিই সর্বেসর্বা । বিনোদনী সংসারের অত নিয়ম কানুন বোঝেনা বাড়ির ছোট সবার একটু প্রশ্রয় আর আদরের সে ছিল সবার ।
স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল তার কারণ তাদের গ্রামে তখন প্রথম মেয়েদের স্কুল হয়েছিল ,বিনোদিনীর ঠাকুমার উৎসাহে বিনোদিনী চতুর্থ বর্ষ পরীক্ষা খুব ভালোভাবে উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু এরপর পড়াশোনা করতে গেলে দুমাইল হেঁটে পাশের গ্রামে যেত হতো । বিনোদিনীর মা চেয়েছিলেন মেয়েকে লেখাপড়া শেখাতে কিন্তু তখন সামাজিক পরিস্থিতি সেইরকম ছিল না, তাছাড়া বিনোদিনীর ঠাকুমার যুক্তি ছিল অত কষ্ট করে পড়াশোনা শিখতে গেলে তাঁর সোনার বরণ নাতনির রূপ নষ্ট হয়ে যাবে । তবুও বিনোদিনীর মায়ের জোরাজুরিতে ওর বাবা বাড়িতে গৃহশিক্ষক রেখে কিছুদূর পড়াশোনা করাবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু বাল্যবিবাহ সামাজিক প্রথা তাকে এড়াতে পারেননি ।
বিনোদিনীর বৌভাতের আয়োজন দুপুরবেলা হয়েছিল । বিনোদিনীর মনে আছে মাথার মুকুট থেকে কোমর অবধি ভারী ভারী সোনার গহনা পরিয়ে তাকে বসানো হয়েছিল গ্রামের লোকজন এসে মুখার্জি পরিবারের নববধূকে দেখবে বলে । একটা বিশাল হল ঘরে একটা চেয়ারে সেই কতক্ষণ তাকে বসতে হয়েছিল মনে নেই কারণ একটা সময় সে ক্লান্ত হয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন পরে। পরে রাঙাদিদি তাকে উদ্ধার করে খাইয়ে দেয়।
এবার এলো ফুলসজ্জা ,রাতে তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে একটা ঘরের পালঙ্কে বসিয়ে সবাই বলে গেল আজ থেকে এটাই তোমার ঘর । বিনোদিনীর খুব ঘুম পেয়েছিল তবু সবাই চলে যাবার পর কৌতূহল বসে ঘরটা ঘুরে দেখতে গিয়ে দেখে শুধু বই আর বই ঘর ভর্তি । হঠাৎ তখন বিনোদিনী শুনে কেউ বলছে তাকে শুধু বই গুলো দেখলে হবে না এগুলো সব পড়তেও হবে। বিনোদিনী অবাক বিস্ময়ে বলে উঠে এই মোটা মোটা বই আমি কেমন করে পরবো। আনন্দ বিনোদনীর বর সে বলে এখানে এসে বসো আমি বলছি তোমাকে সব। বিনোদিনী নির্ভরতা পাই মানুষটার কথায়।
বিনোদিনী তাকে প্রশ্ন করে আপনি বুঝি এইসব বই পড়েছেন । আনন্দ হেসে বলে আমি তো ওকালতি পড়ি তার জন্য অনেক পড়াশোনা করতে হয়। তার ফাঁকে বই পড়ি যখন যা ভালো লাগে। বিনোদিনীর হাতটা ধরে আনন্দ একটা আলমারির কাছে নিয়ে গিয়ে বলে এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা অনেক বই আছে,আর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা অনেক গল্পের বই আছে । তুমি এখন ছেলেমানুষ আরেকটু বড় হও তখন পড়ো এই বইগুলো সব। বিনু বই না পড়লে সমাজব্যবস্থা সমন্ধে জানবে কি করে । আমি চাই তুমি চারদেওয়ালের বাইরের জগতটাকে জানো। বিনোদিনী বলে আমি এখানকার কাউকে তো চিনি না ,আপনি আমাকে এখানকার সবকিছু যদি শিখেয়ে দেন ভালো হয় । আমার খুব ভয় করছে এসে অবধি এখানে । আনন্দ বলল তোমাকে এখানে থাকতে হবে না, আমি ব্যবস্থা করছি তোমাকে আমার সঙ্গে কলকাতায় নিয়ে যেতে। বিনোদিনী বলে সত্যি সেই মস্ত শহরে আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন।
** অলোকা চক্রবর্তী ** **চলবে **
Comments
Post a Comment