ফিরে দেখা (২য় পর্ব)
** ফিরে দেখা ( দ্বিতীয় পর্ব)**
** কলমে -- অলোকা চক্রবর্তী **
আমি জানলায় দাঁড়িয়ে হারিয়ে গেছিলাম পুরানো দিনের সেই স্বপ্নের মত দিনগুলোতে হুস ফিরল বেলা মাসীর ডাকে । জানলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি অত ভাবছিস তুই,খাবি না বেলা তো অনেক হলো অত দূর থেকে এলি এবার হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে একটু রেস্ট নে অনেকটা ধকল গেছে তো তোর আসতে এখানে।
বেলা মাসীকে জড়িয়ে ধরে বললাম কেন জীবনে এত কিছু পেলাম কিন্তু কিছুই তো ধরে রাখতে পারলাম না। বলতো। আজকে তুমি খেতে ডাকছো কতদিন এমন যায় খাবার পরে থাকে খাওয়া হয়না , কেউ নেই ওখানে বলার মত কুহু এবার খেয়ে নে। আমার কতটুকু বয়েস বলো ধূধূ মরুভূমির মধ্যে আমি একা সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
বেলা মাসী বললো কুহু তোর কষ্ট আমি বুঝতে পারি রে তবু তোকে নিজের জন্য ভালো থাকতে হবে।চল মা আজ তোকে নিজের হাতে বেড়ে খাওয়াবো। সেই ছোটবেলায় তুই যা খেতে ভালবাসতিস তাই রান্না করেছি নিজে হাতে।তোর মেসো সব বাজার করে এনেছে আজ নিজে। আমাকে বলেছে মেয়েটাকে দেখে রেখো ওই আমাদের সন্তান আর তো আমাদের কেউ নেই।
আমি খেয়ে এসে শুয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলাম হঠাৎ আমার নাম ধরে কেউ ডাকছে মনে হলো অনেকটা দীপুর মত গলা। বিগত দশবছর যার দেখা পাওয়া তো দূর খোঁজও পাইনি হয়তো বা নেবার চেষ্টা করিনি। আত্মগ্লানিতে ভুগেছি অসহায় হয়ে দিনের পর দিন।
আমাদের যৌথ পরিবারে ছিল একসময়, শুধু তাই নয় গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু পরিবার আমাদের। লেখাপড়ায় এবং আর্থিক দিক দিয়েও। পূর্বপুরুষের কয়েক বিঘা জমি, চালের বিশাল আড়ত, তেলের কল সেইসব থেকে মাস গেলে একটা মোটা টাকা ঠাকুমার কাছে আসত। ঠাকুমায় সংসারের সর্বময়ী কর্ত্রী ছিলেন। ঠাকুমা ভীষন ভালো মানুষ তবু জাতপাতের উর্ধ্বে উঠতে পারেন নি। আমাদের পৈতৃক ব্যবসা বাবা দেখতেন না, জ্যাঠামশাই দেখাশোনা করতেন। বাবা কলেজে পড়াতেন বাদবাকি সময় বই আর আমার পড়াশোনা নিয়ে থাকতেন। বাবা আমার সব আবাদার নির্দ্ধিধায় মানতেন। কিন্তু মা ভীষন কড়া ছিলেন, কথা কম বলতেন।
দীপু যখন পাশ করে ব্যাংকে চাকরি পেল আমাদের দুজনের তখন কত আনন্দ, কত স্বপ্ন কি করে ঘর সাজাবো। দীপু বলতো তুই তো বড়লোক বাড়ির মেয়ে রান্না করতে পারবিনা জানি।তাই মায়ের কাছে একটু একটু করে শিখে নিচ্ছি রান্না আমি ।
আমার তো বদলির চাকরি তুই যা পুতুলের মত তোকে ঘেমে নেয়ে রান্না করতে হবে না। ওসব আমি দেখবো, আমি বলতাম এটা আবার কি রকম কথা তোমার। কোন বাড়িতে ছেলেরা রান্না করে, মেয়েরা সব পারে আমিও শিখে নেবো তোমাকে অত ভাবতে হবে না।
দীপু বলতো ধূস তুই এত পড়াশোনায় ভালো তার উপর সুন্দরী, তোকে কি রান্না ঘরে মানায়। সব নিয়ম গতানুগতিক ধারায় হবে কেন তোর আর আমার সংসার একটু না হয় অন্যরকম হলো। আমার বউ আমার জীবন তাকে আমি আমার উদর ভরানোর জন্য কষ্ট দিতে পারবোনা বাবা সে যে যাই বলুক আর যে নিয়মই থাক।
আমি বলতাম দেখা যাবে তোমার এই ভালোবাসা কতদিন থাকে। কথায় কথায় তো ঝগড়া করো আমার সঙ্গে। দীপু হাসতে হাসতে বলতো তোকে রাগাতে আমার বেশ লাগে কিন্তু মাঝে মাঝে এমন সিরিয়াস হয়ে যাস তখন সব গন্ডগোল হয়ে যায় আমার।
কিছুদিন পর তখন আমার এম,এ ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে দীপুর মা এসেছিলেন আমাকে তাদের বাড়ির বৌ করে নিয়ে যাবার ইচ্ছে এই কথা বলতে। আমার ঠাকুমা,জ্যাঠিমা মুখের উপর ওনাকে না বলে দিয়েছিলেন, ব্রাক্ষণের ছেলে ছাড়া ওনারা মেয়ের বিয়ে দেবেন না। দীপুর মা খুব অপমানিত হয়ে চলে যান সেদিন।
আমি বাবার কাছে গিয়ে খুব কেঁদেছিলাম বলেছিলাম তুমি কেন এই গোঁড়ামি মানছো। মানুষের মূল্য কি জাত দিয়ে হয়। তুমি জানো তো আমি দীপুকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারবো না। বাবা আমাকে বললেন সংসারের এইসব নিয়ম যেমন আমি মানিনা তেমন এই নিয়ম ভাঙ্গতেও পারবো না।
তার চেয়ে তুই এখান থেকে চলে যা-- নিজের মত ভালো থাক, পরে আমি সবাইকে বুঝিয়ে তোর সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবো। সেই সময় যে মা এসে ঘরে দাঁড়িয়েছেন বুঝিনি, মা চিৎকার করো বলল আমার মাথার দিব্যি তুমি যদি ওই ছেলের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করো তবে তোমাকে আমার মরা মুখ দেখতে হবে। নিচু জাতের ছেলে কিছুতেই এই বাড়ির জামাই হতে পারে না। মাকে বাবা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছিল মায়ের এক গোঁ। উল্টে বাবাকে আদেশ করলো যত তাড়াতাড়ি পারো মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করো নইলে আমি নিজেকে শেষ করে দেবো বলে রাখলাম। তার মাস খানেক পর বাড়ি থেকে না বলে চলে এসেছিলাম কাউকে কিছু না বলে একটা চিঠি লিখে এই চাকরির জায়গায়। আমি তো মায়েরই মেয়ে জেদ তখন আমারও কম ছিল না।
** চলবে**
Comments
Post a Comment