ফিরে দেখা (১ ম পর্ব)
** ফিরে দেখা (প্রথম পর্ব ) **
** কলমে -- অলোকা চক্রবর্তী**
অনেকদিন পর আমি আজকে আমাদের গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছি। অনেকদিন হলো আমি কর্ম সূত্রে বাংলার বাইরে আছি। আগে তবু বাবা,মা থাকাকালীন অন্তরের টানে মাঝেমধ্যে এই বাড়িতে এসে কাটিয়ে যেতাম। তখন কয়েকদিন দেরী হলেই মা, বাবার ঘন ঘন ফোন আসতো তাই সবকাজ ফেলে ছুটতে হতো। কতবার আমার কাছে তোমরা এসে থাকো কিন্তু বাড়ি ছেড়ে মোটেই থাকতে চাইতো না। বেড়াতে আসত মাঝে মাঝে মা, বাবা আমি তাদের একটি মাত্র সন্তান তাই একমাত্র অবলম্বন ছিলাম।
এই বাড়ির প্রতিটি দেওয়াল, দরজা,জানলা আমার জীবনের সঙ্গে ভীষনভাবে জড়িয়ে আছে। আমার ছোট থেকে বড় হওয়া এই বাড়িতে। আমার এখন ছোটবেলার সবকথা মনে না থাকলেও এই বাড়ির দেওয়ালে কান পাতলেই সেই সব গল্প নিশ্চয় শোনা যাবে ওরা যে সাক্ষী আমার ছোট থেকে বড় হবার জীবনে সঙ্গে।
আজকাল আমার খুব একা লাগে কাজের চাপে সারাদিন কেটে যায় কিন্তু রাত যত গভীর হয় আমার তত একা লাগে। সেই জন্য অদ্ভুত এক অনুভূতি আমার কয়েকদিন ধরে হচ্ছিল বাড়িটাকে দেখার জন্য।
মনে হচ্ছিল আমাদের বাড়িতে কয়েকদিন কাটিয়ে এলে হয়তো মনটা কিছুটা ভালো হবে। সেই উদ্দেশ্যে অফিসে থেকে ছুটি নিয়ে আমাদের বাড়ি দেখাশোনা করে আমার মায়ের দূর সম্পর্কের বোন বেলা মাসীকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম আমি আসছি।
আমি বাড়ির গেট খুলে ঢুকতেই বেলা মাসী ছুটে এসে জড়িয়ে বলল 'কুহু' ! এইরকম করে বাড়ি ঘর ছেড়ে কেউ থাকে দিনের পর দিন।কতদিন পর এলি বলতো আমরা কি তোর কেউ নই।
আমার মাসীর স্নেহের শাসনে চোখ জলে ভরে গেল যে শাসনের আজকাল খুব অভাব বোধ করি,কোন রকমে চোখ জল সামলে বলি এখন কদিন তোমার আদর খাবো বলে তো এলাম এখানে। তুমি আর মেসো ছাড়া দুনিয়ায় আর কে আমার আছে বলো। বাইরের জগতের সব সম্পর্ক তো স্বার্থে বাঁধা গো।
আমি আমার ঘরে ঢুকে জানলা খুলে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম আমাদের বাড়ির পেছনে সেই বিশাল দীঘিটাকে । যেটা এই অঞ্চলের গোঁসাই দীঘি নামে পরিচিত। দীঘিটা আমাদের পূর্বপুরুষের কেউ সুন্দর গাছপালা দিয়ে সাজিয়ে ছিল।
এখন বেশীভাগ দীঘিটা দখল করেছে বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদের দল। ওরাই দীঘির সৌন্দর্য অনেকটাই কেড়ে নিয়েছে। এককালে গোটা দীঘির জলে আকাশের ছবি পরিস্কার দেখা যেত। পুর্নিমা দিনে কত রাত আমার মেয়েবেলার কেটেছে এই দোতলার জানলায় বসে দীঘির জলে চাঁদের প্রতিবিম্বের লুকোচুরি খেলা দেখে। নিস্তব্ধতার মাঝে অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা সেইসব দিন কেমন করে যেন আসতে আসতে হারিয়ে গেল।
তখন আমার কিশোরী মনের দখল করে রাখা দীপাঞ্জন ওরফে দীপুকে যখনই বলতাম সেইসব গল্প ,দীপু হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলতো রাত জেগে ওসব না দেখে পড়াশোনাটা একটু মন দিয়ে করলে তো কেন কম নম্বর পেলাম এই আফশোষ তোর থাকে না।
দীপু সঙ্গে এই নিয়ে কত কথা কাটাকাটি হয়েছে আমার তার ঠিক নেই। কখনও দীপু বলতো কোনদিন তুই বলবি ঘোড়া ক্ষুরের শব্দ শুনতে পাশ যে রাজপুত্র তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে তোকে নিতে আসবে ।
আমি রেগে বলতাম তুই থাকতে অন্য রাজকুমার আসবে কেন আমাকে নিতে। দীপু হাসতে হাসতে বলতো তুই তো কল্পনা বিলাসী হয়তো ভাবতেও পারিস। সে এক সুন্দর সময় কেটেছে দীপু রাগাত আর আমি চোখ ছলছল করে বলতাম যাও আমি আর তোমার সঙ্গে কথা বলবো না।
দীপু বলতো ওরে বাবা তাহলেই তো আমি শেষ। যতই আমার ব্যস্ততা থাকুক তোকে না দেখলে থাকতে পারি না জানিস তো ভালো করে। 'কুহু পাগলী'! তুই জানবি এই পৃথিবীর আর কেউ তোকে আমার থেকে বেশি ভালবাসতে পারবে না। পৃথিবীতে যদি বেঁচে থাকি তবে দুজনে মিলেই বাঁচবো যেখানে ভালবাসার অভাব থাকবে না পার্থিব আর যা কিছুর অভাব থাকুক।
কিন্তু বিধাতা আড়ালে হয়তো শুনেছিলেন আমাদের সেইসব কথা ওনার দয়ায় তাই হারিয়ে যায় আমার জীবনের সেই পরম ভালবাসার গল্প। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয় সংসারের নানা চাপে , নানা প্রয়োজন মেটাতে কখনও মানুষ অসহায় হয়ে সময়ের হাতে নিজেকে বন্দী করে ফেলে। তখন জীবনের গল্প গুলো নিজের আয়ত্তে থাকেনা অন্যভাবে সেজে উঠে যা কল্পনাতেও ছিল না।
** চলবে**
Comments
Post a Comment