নীলকমল
** নীলকমল **
** কলমে -- অলোকা চক্রবর্তী **
নীলকমল ওর এই নামটা কে রেখেছিল তা আমি জানি না। কেউ ওকে ডাকতো নীল,কেউ ডাকতো কমলি। আমি ওকে প্রথম দেখেছিলাম তখন ও সদ্য তরুনী খুব জোর তের কিম্বা চোদ্দো বছর হবে। পদ্ম ফুলের মত পবিত্র একটা মেয়ে মনে হয়েছিল। মনে মনে বলেছিলাম এই পদ্ম একশ আটটা নয় একটাতেই যেকোন দেবতা সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন।
আমি তখন নীলকমলদের গ্রামের পোষ্ট অফিসের পোষ্ট মাষ্টার হয়ে গেছি। ওই পোস্ট অফিসের অন্য এক সহকর্মীর বাড়িতে অতিথি , শহরের ছেলে একদম অজ গ্রাম কি করে মানিয়ে নিয়ে থাকবো এই চিন্তায় মনে মনে অস্থির হতাম।
আবার সরকারি চাকরি ছেড়ে দেবো এই সাহসও নেই ,তার উপর বাবার কথা ছিল পুরুষ মানুষ হয়ে জন্মেছো যেখানে শোয়ার জায়গা পাবে শুয়ে পরবে, যা পাবে হাতের কাছে তাই পেট পুরে খেয়ে নেবে।
দিন কয়েক পরে সেদিন ছুটি ছিল অফিসের সহকর্মী সুকান্তদার বারান্দায় বসে গল্প করছি সেই সময় নীলকমল ওর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে উপস্থিত হয়। দেখলাম মেয়েটা গ্রাম্য সাজ হলেও অন্যরকম লালিত্য আছে। কথা বলার মাধুর্য্য আলাদা। ওর সঙ্গী মেয়েরা ফ্রক পরলেও নীলকমল আটপৌরে করে খুব সাধারণ একটা শাড়ি পরেছে তাতে ওকে পরীর মত লাগছে।
নীলকমল ঢুকে প্রথমে আমাকে পর্যবেক্ষণ শুরু করে তারপর বলল কাকু তোমার বাড়ির নতুন অতিথিকে আমাদের গ্রাম দেখিয়েছো,নইলে বলো আমি না হয় দেখিয়ে দেবো। সুকান্তদা নীলকমল কে বলে সে হবে এখন ,তুই আগে বল কেন এসেছিস তোর তো কাকুর খোঁজ নেবার এখন সময় হয়না।
নীলকমল উত্তর দিল আমি চিঠির খোঁজে আসিনি গো জানি আমাকে চিঠি দেবার কেউ নেই। আমি এসেছি তোমাদের নিমন্ত্রণ করতে। আমাদের সরস্বতী পূজো দেখতে আর সন্ধ্যাবেলায় অনুষ্ঠান দেখতে যেও সবাই মিলে।
আমি তখন মজা করি বলি সরস্বতী পূজোয় চাঁদা লাগবে না, নীলকমল উত্তর দিল আমরা সবাই টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে ভাঁড়ে সারাবছর জমা করি একসাথে।বড় জ্যাঠিমার কাছে থাকে সেই ভাঁড়। ওর থেকে আমাদের পুজো হয়ে যায়।
সুকান্তদার কাছে শুনেছিলাম মা মরা মেয়ে ওর মামার কাছে মানুষ। ওর বাবা মেয়ে হবার খবর শুনে মেয়ের মুখও দেখেনি,ওর মায়েরও খোঁজ নেয়নি।
এরপর নীলকমলের সঙ্গে আমার কথাবার্তা হতো,মাঝে মাঝে আমার পোস্ট অফিসে আসতো, জিজ্ঞেস করতো চিঠি মধ্যে কি সব লেখা যায়। আমি বলেছিলাম নিশ্চয় লেখা যায় , মুখে তো সব কথা বলা যায়না।
সুকান্তদার বাড়ি ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে চলে যাই আমি কয়েকদিন পর।সব ব্যবস্থা করলেও আমার তো যোগ্যতা ছিল না রান্না করে খাবার। একদিন দুপুরে অফিসে কাজ করছি সেদিন সুকান্তদা আসেনি নীলকমল এসে বলল তুমি আর কাকুর বাড়িতে থাকনা শুনলাম। তা খাচ্ছো কি মাষ্টার মশাই, তোমরা শহরের লোক হাত পুড়িয়ে রান্না করতে পারবে?। আমি বললাম আমি সত্যি পারিনা আজকে আমার খাওয়া হয়নি ,চলো দেখি কোথাও কিছু পাওয়া যায় কিনা খিদেটাও পেয়েছে বেশ ।
নীলকমল বলল গ্রামে তুমি কি পাবে এই দুপুরবেলা এতদিন গ্রামে আছো জানোনা। তুমি অফিসে থাকো আমি আসছি এখনই ।আধ ঘণ্টা পরে রুটি আর আলুর তরকারি, বেগুন ভাজা একটা কৌটতে এনে বলল এই অবেলায় ভাত খেতে হবেনা এটা খাও।
তারপর অনেকদিন কেটে গেছে নীলকমল এখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর নাটকের রতনের মত। আমার সব দায়িত্ব ও নিজে তুলে নিয়েছে। সকাল থেকে রাত খাবার ঘরদোর গুছিয়ে রাখা সব নিজে হাতে করে। কখন সব গুছিয়ে করে আমি টের পাইনা।
নীলকমল বড় হয়েছে ওর লাবণ্য আমাকে মুগ্ধ করতো কিন্তু কিছু বলতে পারিনি। ওর অক্লান্ত সেবা নিয়ে গেছি দিনের পর দিন। ভেবেছি বলবো ওকে আমার মনের কথা আবার ভেবেছি ও যদি শুনে আর না আসে।
বেশ ছিলাম কিন্তু একদিন বাবা দুপুরে এসে আমাকে বললেন তোমার জিনিস পত্র গুছিয়ে নাও আমার বন্ধুকে ধরে শহরের কাছাকাছি তোমার বদলি করিয়ে নিয়েছি।
সেদিন নীলকমলকে কিছু বলে আসতে পারিনি , নিজের ভীষন খারাপ লেগেছিল, মনে মনে নিজেকে ভীষন অপরাধী মনে হচ্ছিল। দিন পনেরো পরে সব মিটিয়ে আসবো বলে গিয়ে দুদিন থেকেছি কিন্তু নীলকমলের দেখা পাইনি।ওর বন্ধুদের কাছে বলেছি ওকে ডেকে দেবার জন্য নীলকমল আর আসেনি।
পরে বাবা, মাকে বলেছিলাম নীলকমলের কথা ওনারা মানেনি। বলেছিলেন গ্রাম্য মেয়ে শহরে মানুষের অনুপযুক্ত যত তাড়াতাড়ি ভুলবো তত মঙ্গল আমার।
আমি হয়তো ভালবেসে ফেলেছিলাম গভীর ভাবে নীলকমলকে নিজের অজান্তে তাই জন্য অন্য কোন মেয়ে আমার জীবনে পরিপূরক হয়ে উঠতে পারেনি নীলকমলকে সরিয়ে। নীলকমল আমার কাছে পরীর মত থেকে গেছে হৃদয়ের সবটুকু জুড়ে আজ বেলাশেষের শেষ বেলায়।
Comments
Post a Comment