ভালো থেকো আমার জন্য (শেষ পর্ব)
**ভালো থেকো আমার জন্য ( প্রথম পর্ব) **
** কলমে -- অলোকা চক্রবর্তী **
আমি মালিনী ,খুব সাধারণ এক মেয়ে যার স্বভাব আর পাঁচটা মেয়ের শান্ত মেয়ের মত ভীতু, ঝামেলা-- ঝগড়া খুব এড়িয়ে যাই । আমার সরলতার জন্য বন্ধুরা আমাকে খুব ভালবাসত এখনও একই রকম সবার ভালবাসায় আমার ঝুলি ভর্তি । আমার মনে হয় আমার ব্যবহারই আমার পরিচয়, যা সবাই মনে রাখবে। আমি যখন বড় হচ্ছি সদ্য তরুনী তখন এক ভাললাগার দমকা হাওয়া হাওয়া এসে আমার চিন্তা ভাবনা গুলো এলোমেলো করে দিল, মনের ভিতর এক ঝড় বইতে লাগল এক অন্য অনুভূতিতে।
আমার জীবনে তখন তাঁর আবির্ভাব হয়, সে থাকত আমাদের স্কুলের কাছাকাছি ।প্রতিদিন স্কুল যাওয়ার পথে সে দাঁড়িয়ে থাকত ,তাঁর সাথে চোখাচোখি হতো রোজই।পরে তাঁর নাম জেনেছিলাম রঞ্জন ।সে খুব সুন্দর চিঠি লিখতে পারত।কিছুদিন পরপর আমার বন্ধু মারফত সে আমাকে চিঠি পাঠাত ,তাঁর চিঠির প্রতিটি লাইন শুধু এক গভীর নিষ্পাপ ভালবাসার কথা লেখা থাকত ।
আমি ও ভীষণ ভাললাগায় মুগ্ধ হয়ে পড়তাম চিঠি গুলো, মনে মধ্যে আলোড়ন চলত কিন্তু উত্তর দেওয়ার সাহসে কুলাতো না, ভাবতাম এত মেয়ের মাঝে আমি তার কাছে অসামান্য হলাম কি ভাবে ।দিন যেতে লাগল আমিও তাকে মনের সবটুকু দিয়ে ভালবাসে ফেলাম কিন্তু প্রকাশ করতে ভয় পেলাম বাড়ির অনুশাসন এবং পরিবেশ , পরিস্থিতির জন্য।তাঁকে একদিন না দেখলে মন ছটফট করত ,থাকতে পারতাম না তবুও তাঁকে জানতে দিলাম না আমার মনের কথা ।
তাঁর প্রত্যেক টা চিঠিতে থাকত আক্ষেপ কেন সে আমার ভালবাসা পায় না ,তাও আমি প্রকাশ করতে পারলাম না যে আমিও তাঁকে ভীষণ ভালবাসি আমার নিজের থেকে বেশী।
এরপর পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলে আমার ভালবাসা কে ফেলে পরিস্থিতির চাপে আমি হয়ে গেলাম অন্য কারুর বৌ।আমার বিয়ে হয়ে গেল অন্য জায়গায়, অন্য বাড়িতে চলে এলাম ।আমি এখন গৃহবধূ, সংসার সামালাই ।দায়িত্ব পালন আর কর্তব্যের জালে নিজেকে জড়িয়ে নিলাম,ভুলতে চেষ্টা করলাম ফেলে আসা সব স্মৃতিকে ।সবার কাছে এক সুখী মানুষের রুপ দেখাতে তো হবে এইভাবে দিন কাটাতে লাগলাম মেয়েরা যেমন থাকে সংসারে।
এই পোড়াদেশে মেয়েদের মনের ঠিকানা কে রাখে ।সবাই ভাবে তুমি মেয়ে, সংসারই তোমার ঠিকানা, তোমার সব অস্তিত্ব ওখানেই । স্বামী আর সন্তান নিয়ে ভালই দিন কাটছিল ,অন্ততঃ সবার কাছে আমি হয়ে উঠেছিলাম এক আদর্শ গৃহবধূ হয়ে । স্বা্মীর স্বীকারোক্তিও ছিল সে নাকি ভীষন ভাগ্যবান তাই আমার মত স্ত্রী সে পেয়েছে। একটা মেয়ের এর থেকে আর কিইবা বেশি চাওয়া হতে পারে। অনেক বছর এই গড্ডোলিকা প্রবাহে কেটে গেল আমার মেয়ে জীবনের ইতিবৃত্ত। তবে কখনো কখনো আমার জানার বাইরেও কিছু ঘটনা ঘটে যায়।
মাঝে একবার বাপের বাড়িতে গেছি তখন হঠাৎ আমার বান্ধবী সীমার সাথে দেখা হয়ে গেল।সীমা হল সেইজন যে একমাত্র আমার আর রঞ্জন এর সম্পর্কের কথা জানত কারণ অধিকাংশ চিঠি সীমাই আমাকে এনে দিত। সীমা তো প্রথম দেখা হতেই একরাশ অভিযোগ করলো আমার ভালবাসা নিয়ে, আমার কঠোর মানসিকতা নিয়ে ।
সীমার অভিযোগ আমি কেন রঞ্জনের মতো ভালো ছেলের ভালবাসা কে অবহেলা করলাম, কেন রঞ্জন কে প্রত্যাখ্যান করলাম?,ইত্যাদি বলতে লাগল ।আমি শুধু আভিজাত্যে দেখেছি,ভালবাসা দেখিনি ।আমি যা পেয়েছি তা কি ওর রঞ্জন দিতে পারত না ।সীমার কথা গুলো শুনে চোখের জল ফেলেছিলাম মুখে কিছু বলতে পারিনি। তবু সীমা বুঝতে পারল আমি ও ভালবাসতাম রঞ্জন কে।তারপর দুই বান্ধবীর অনেক মনের কথার আদান - প্রদান হলো যা বহু বছর নীরবে জমা ছিল একান্তই।
আজকাল সীমার সাথে প্রায় কথা হয় ফোনে, সীমার কাছেই রঞ্জনের সব খবর পাই । সীমার কাছে জানতে পারি রঞ্জন একটা কলেজে পড়ায় আর বাকী সময় বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকে।আমি ছাড়া অন্য কেউ ওর জীবনে আসুক ও চাইনি তাই একলাই থেকে গেছে । আমি যখন এইসব ভাবি অনুশোচনায় ভীষণ কষ্ট পাই আর আমার অযোগ্যতাকে মানিয়ে নিই। মেয়েদের ভাগ্যকে ভীষণ ভাবে মেনে নিতে হয়, হয়তো একটা জীবনে সবাইকে সুখী করতে গিয়ে নিজে কিসে সুখী তা ভাবা হয়না।
বেশ কিছুদিন হলো আমার শরীরটা ঠিক যাচ্ছে না ।বাড়ির ডাক্তার কতগুলো শারীরিক পরীক্ষা দিয়েছেন ।যার জন্য আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে ।ভর্তির আগে সীমা সাথে অনেক কথা হয়েছে ও বলল চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে । আজ দুদিন হাসপাতালে ভর্তি ,বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য শারীরিকভাবে খুব ক্লান্ত ছিলাম ।বাড়ির লোকেরা চলে যাবার পর চোখটা বন্ধ করে একটু শুয়ে ছিলাম ।হঠাৎ হাতের উপর জলের স্পর্শ তাকিয়ে দেখি আমার সামনে রঞ্জন ,ওর চোখ দুটো জলে ভেসে যাচ্ছে ।
আমাকে হাতের ইশারায় চুপ করে থাকতে বলে রঞ্জন বলল আমার বাড়ির লোকরা চলে যাবার পর হাসপাতাল কতৃপক্ষ কে অনেক অনুরোধ করে দশমিনিটের জন্য ও আসতে পেরেছে আমার কাছে তবে একটাই শর্তে কোন কথা বলতে পারবে না ।আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ,শুনছি আর ভাবছি এতবছর যাকে গোপনে সযন্তে হৃদয়ে রেখেছিলাম তাকে মনের সবটুকু দিয়ে দিয়েছি এতবছর পর তাঁকে দেখছি আমার সামনে ।মুখের আদল একইরকম আছে শুধু চুলে সামান্য পাক ধরেছে। আমার এতবছরের বাঁধ ভেঙ্গে গেল, ডুঁকরে কেঁদে ফেললাম ওর হাত ধরে ।কত কথা,কত ভালবাসা ওর জন্য লুকানো ছিল আমার গোপন হৃদয়ে কুঠুরিতে।
এই ভাবে প্রায় ত্রিশ মিনিট কেটে গেল দুজনের চোখের জলে সব মান অভিমানের দূরত্বের ভাষা ঘুচিয়ে ।এরপর রঞ্জন উঠে দাঁড়িয়ে বলল এবার আমি আসি কেমন , তুমি ভালো থেকো আমার জন্য ।আমার সব বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছিল তবুও তাঁর যাবার দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলাম তাকে তো আমি কিছুই দিতে পারেনি তবে কেন চোখের জলে তাঁর পথ পিচ্ছল করবো ।সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল " আমার কথা রেখো আমার জন্য অন্তত ভালো থেকো তুমি "।
** ক্রমশ **
Comments
Post a Comment