দেবতনয়া ( শেষ পর্ব)

** দেবতনয়া (শেষ পর্ব)  **



বিন্দুর বিয়ে আজকে সকাল থেকে নহবত বাড়িতে বাজচ্ছে,বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজন যে যার মত আনন্দ হাসি ঠাট্টা, গল্প করছে। সমস্ত ব্যবস্থা আমি আমার সামর্থ্য অনুযায়ী করেছি, সবাই বলাবলি করছে এইরকম মেয়ের বিয়ের আয়োজন খুব মানুষই করতে পারে।

      তবু আমার মনটা ভালো নেই ভেতরটা হুঁ--হুঁ করছে বিন্দু আমাকে ছেড়ে চলে যাবে এই ভেবে। জানি একটা সময় মেয়েদেরকে বাবার আশ্রয় ছেড়ে চলে যেতে হয় নিজের সংসার গড়তে। চিরন্তন সংসারের ইতিহাস এই গল্প দিয়েই তৈরী সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য। সেই সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্যই  মেয়েদের বাবারা নিজেদের কষ্টকে চেপে মেয়েকে পাত্রস্থ করেন ।

      বিন্দুর গায়ে হলুদ হচ্ছে মহিলাদের উলুধ্বনি,শঙ্খ তে গোটা বাড়ি মুখরিত, আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছি। তখন শুনি বিন্দুকে ওর মা  বলছে "তুই কাকে খুঁজছিস?",সবাই কেমন আনন্দ করছে আর তোর মুখে হাসি নেই কেন। বিন্দু বলল 'মা' ! -'বাবা' -কোথায় গো ?। বাবা এখনও কিছু খাইনি না?। 

      বিন্দুর মা বলল তোর খাওয়া না হলে কবে তোর বাবা খাই বলতো। বিন্দু বলল তোমারই তো আমাকে বললে বিয়ের দিন কিছু খেতে নেই কিন্তু বাবা  খাইনি কেন ?। বাবার পিত্তি পরলে কি হবে বলতো। আমি থাকবো না  তখন যদি বড় ব্যামো হয় কে দেখবে শুনি। 

      বিন্দুর জ্যাঠিমা বলল বাপ সোহাগী মেয়ের অবস্থা দেখো ,ওরে ! আমরা তো আছি তোর বাবার জন্য তোকে অত চিনতে করতে হবে না।  আমি ওখান থেকে সরে এলাম চোখের জল সামলাতে।

       সন্ধ্যা বেলায় আমি দাদা, ভাইকে সব বুঝিয়ে দিয়ে ঘরে এসে বসেছি  আর ভাবছি সারাদিন  বাড়ি শুদ্ধ লোক নিয়মে বাঁধতে যে মেয়েটাকে  হিমসিম খেতো  সে কি করে অন্য বাড়ির নিয়মে নিজেকে বাঁধবে। 

      এমন সময় শুনি 'বাবা' ! -- চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি আমার বিন্দু দূর্গা প্রতিমার মত সেজে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। পেছনে পেছনে ওর মা এসে বলল ছাতনাতলায় তোকে নিয়ে যাবে  বলে সবাই দাঁড়িয়ে আর তুই কিনা এখানে এসেছিস।

      বিন্দু আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতে লাগলো বাবা ! তুমি সবাইকে বলো আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। আমি তোমার মেয়ে হয়েই থাকতে চাই ,ওর মা বিন্দুকে টেনে নিয়ে বলল মা! রে  তোর বাবা তোরই থাকবে।তোকেও যে তোর মেয়ে ধর্ম পালন করতে হবে। আমাদের সংসারে সবার জন্য নির্দিষ্ট করা আছে সেই মত পালন করতে হবে।

      বিন্দু বলল অত কঠিন কথা বলোনা তো তুমি, সবাই যা করেছে আমাকেও কি তাই করতে হবে। আমার দাদার মেয়ে সেইসময় ঘরে ঢুকে বিন্দুকে বলল তোর মত আমিও ভেবেছিলাম কিন্তু এখন আর কোন কষ্ট হয়না দেখবি তোরও কষ্ট হবে না কয়েকদিন পর।

      বিন্দুর মা বিন্দুকে নিয়ে চলে গেল আমাকে বলল মেয়েকে সম্প্রদান করতে হবে তুমি তৈরী হয়ে ছাতনাতলায় যাও। বিন্দুর মাকে বললাম সে দায়িত্ব আমি দাদাকে দিয়ে এসেছি। বিন্দু হঠাৎ কান্না জড়ানো গলায়  বলে উঠল ,"না বাবা তুমিই  আমাকে দান করে দিও , আমি তো  তোমার মেয়ে" ।

      পরেরদিন সকালে সবকিছু গোছগাছ হচ্ছে বিন্দু শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে একটু পরে, পালকিও তৈরী। আমি সবাইকে এড়িয়ে লুকিয়ে  বাগান পেরিয়ে দীঘিতে এসে বসলাম। ভিতরে কান্না লুকাতে নইলে সবাই বলবে পুরুষ মানুষের চোখের জল এ কেমন কথা।  আমি যে বাবা, বিন্দু যে আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন সেকথা কি করে প্রকাশ করি।

      ভাবছি মেয়েটা আর কয়েকটা দিন থাকতো আমার চোখের সামনে তাহলে এমন কি অনর্থক হতো। আমার কি সমাজের এই নিয়মের বাইরে কিছু ভাবা উচিত ছিল। একজন কে তো সমাজের নিয়মের ব্যতিক্রম হতে হয় তাহলে তো এই ছোট্ট বয়েসে মেয়েটাকে বাবা মায়ের আশ্রয় ছেড়ে অন্য জায়গায় যেতে হতো না। ন্যায় ,অন্যায় নানা রকমের ভাবনায় আমি অস্থির সেই সময় কথার গুঞ্জন কানে এলো।

      আমি তাকাতে দেখি বিন্দু ওর মা আর আমার দিদিরা। আমার দিদি বলল ভাই তুই তো জানিস ভালো করে তোর মেয়েকে। তাছাড়া মেয়েটার বিদায়ের সময় আশির্বাদ না করে তুই এখানে কেন বসে আছিস।

      আমি তাকাতে পারছি না বিন্দুর দিকে শুধু মুখে বললাম যাচ্ছি চল। বিন্দু আমার হাত ধরে বলল তুমি কেন সবার কথা শুনলে বাবা আর কয়েকটা দিন আমাকে না হয় থাকতেই দিতে তোমার কাছে।

      সবাই বিন্দুদের ধরে নিয়ে গেল আমি সবার পিছনে পিছনে আর বিন্দু বারবার পিছন ফিরে আমার দিকে অসহায় ভাবে তাকাচ্ছে। 

      একটু পরেই বিন্দুর শ্বশুরবাড়ি লোকেদের তাড়াহুড়োয় বিন্দুদের পালকি তে বসিয়ে রওয়ানা করে দেওয়া হলো। আমি কিছুদূর এগিয়ে যাই ওদের সঙ্গে। বিন্দু আমার অসহায়  চোখ ভর্তি জল নিয়ে পালকি থেকে মুখ বাড়িয়ে। আস্তে আস্তে দূরে পালকি চলে গেল, আমি দূর্দান্ত প্রতাপ জমিদার 'দেব নারায়ন ভট্টাচার্য' দাঁড়িয়ে গেলাম সমাজের বিধিবদ্ধ নিয়মের কাছে হেরে।


Comments

Popular posts from this blog

আমার স্বপ্নের ঘর

মল্লিকাঅর্জুন ( চতুর্থ পর্ব)

আমি সেই মেয়েটা