দেবতনয়া ( দ্বিতীয় পর্ব)
**দেবতনয়া ( দ্বিতীয় পর্ব) **
এরপর ছেলের বাড়ির কোন একজন বিন্দুকে প্রশ্ন করেন মা রান্না করতে পারো তো। বিন্দু উত্তর না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।ওর চোখের ভাষা যেন আমাকে নিরবে বলছে মেয়েদের কেন প্রতিনিয়ত এত লাঞ্ছনা। কেন মেয়েদের সবকিছু জানতে হবে, শিখতে হবে,রূপ থাকতে হবে, চুলের সৌন্দর্য থাকতে হবে। মেয়েদের কেন এত পরীক্ষার সম্মূখীন হতে হবে।
আমি সেদিকে তাকাতেই আমার মা আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বোঝাতেই চাইলেন তুমি মেয়ের বাবা কোন জবাব নয়। দেখলাম আমার ভাই বলল মেয়েদের ঘাড়ে দায়িত্ব পরলেই সব শিখে যায় ওই নিয়ে ভাববেন না। আমি বিন্দুর চোখের ভাষা পড়েও নির্বাক থাকলাম কারণ আমি যে মেয়ের বাবা এই দায়বদ্ধতায়।
আমি ভাবছি এই সব মানুষদের বুদ্ধিহীনতা কথা , এদের অজ্ঞতা কতটা। সংসারে পুরুষেরা কি করে ?, সেতো শুধু সংসারের রসদ জোগাড় করে।আর মেয়েরা মা লক্ষ্মী হয়ে নিজের গুণে , কর্মদক্ষতায় সংসারের মানুষগুলোর সমস্ত চাহিদা পূরণ করে, সন্তান কে পৃথিবীর আলো দেখায় নিজেকে নিঃশেষ করে। মেয়েদের যে মা দূর্গা স্বয়ং বিরাজ করেন।
আমার মনটা কেমন বিদ্রোহ করে উঠছে বারবার, আমার আদরের বিন্দুকে কি বিয়ের পরে এই মানুষগুলোর মনোরঞ্জনের জন্য সারাদিন হেঁসেলে আগুনের সামনে বসে নানা ব্যঞ্জন রান্না করতে হবে?। দরকার নেই এমন বিয়ে দেবার। বাবার কি অধিকার থাকতে পারে না মেয়েকে সারাজীবন নিজের কাছে রেখে দেবার এ কেমন সমাজের নিয়ম।
কিছু সময় পর ছেলের বাড়ির লোক বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে বিদায় নিল। আমি ওনাদের এগিয়ে দিয়ে ঘরে এসে বসে ভাবচ্ছি বিন্দুকে আমার চোখের সামনে না দেখতে পেলে আমি একটা দিনও থাকতে পারি না তাকে পরের ঘরে পাঠিয়ে কি আমি শান্তিতে থাকতে পারবো। সেসব দিন তো আমার কাছে ভয়ানক যন্ত্রণার হবে।
আমাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে বিন্দুর মা কনক ঘরে ঢুকে আমাকে প্রশ্ন করে "কি হয়েছে তোমার ?,এই অসময়ে তুমি বৈঠকখানা ছেড়ে অন্দরমহলে"?।
বললাম বিন্দুর বিয়ে দিয়ে পরের ঘরে পাঠাবো এই চিন্তা আমাকে অস্থির করে তুলেছে যে বৌ।
বিন্দুর মা বলল মেয়ে বড় হলে বাবার তো এটাই প্রধান কর্তব্য। আমি বললাম কতটুকু মেয়ে আমার, কি করে অজানা মানুষগুলোর মন যুগিয়ে চলবে। ওকি সংসারের কত রকমের নিয়ম ,কত রকমের বায়নাক্কা এইসব জানে?।
বিন্দুর মা বলল মনে করে দেখো আমি কতটুকু বয়েসে তোমাদের এই বাড়িতে এসেছিলাম।এই বাড়ির মানুষজন , তুমি কেউই কিন্তু আমার পরিচিত জন ছিলেনা। মেয়েদের ভগবানই শক্তি দিয়ে পাঠান অজানা মানুষজনকে আপন করে নেবার ওসব নিয়ে ভেবোনা।
আমি বললাম বৌ তোমাকে যেভাবে সমাজ, সংসার সবকিছু থেকে আমি আগলে রেখেছি সেরকম কজন পুরুষ মানুষ পারে বলতো। বিন্দুর মা বলল তুমি বা আগের থেকে ধরে নিচ্ছো কেন খারাপ হবে হয়তো দেখবে সে আরো ভালবাসা, আরো সহমর্মিতা দিয়ে আমাদের বিন্দুকে আগলে রাখছে।
সেই সময় বিন্দু ঘরে ঢুকে বলল বাবা ! বড়দা বলল তুমি নাকি আমার বিয়ে হবে বলে মনখারাপ করে বৈঠকখানা ছেড়ে এখানে। দরকার কি বাপু এমন বিয়ের তোমাদের দেবার। বাবার মন খারাপ হবে এমন বিয়ে আমি চাই না।
আমি বলি হ্যাঁ রে বিন্দু আমাকে ছেড়ে তোর থাকতে কষ্ট হবেনা শ্বশুরবাড়িতে। বিন্দু কোমরে হাত দিয়ে বলল তোমরাই তো আমার বিয়ে বিয়ে বলছো খালি। কেন মেয়েদের বিয়ের জন্য তোমাদের এত হুটোপুটি বাবা-- মায়েদের। আমার কতগুলো বন্ধুর এই কমাসে বিয়ে হয়ে গেল। অথচ আমার থেকে বড় কানাই দাদা,বাসুদাদা,বিবেক দাদাদের বিয়ের কথাটা তো কেউ বলো না। কেমন যেন বাপু তোমরা সবাই একপেশে সিদ্ধান্ত নাও।
আমি বিন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছি বিন্দু তুই যে প্রশ্ন আমাকে করলি সেই প্রশ্ন যে আমারও। কেন পুতুল খেলা বন্ধ করিয়ে তোদের এই ছোট বয়েসে শ্বশুরবাড়ি নামক এক কঠিন বাস্তব জগতে প্রবেশ করানো হয়। হয়তো আমার মত সব বাবাদের মনে এই প্রশ্ন জাগে,আঘাত করে আবার সমাজের নিয়মের কাছে হারও মানে তাঁরা।
Comments
Post a Comment