কন্যাদান (শেষ পর্ব)
**কন্যাদান (শেষ পর্ব)**
** কলমে--অলোকা চক্রবর্তী**
আমি বড় হলাম আস্তে আস্তে নানা মানুষের নানা রূপ দেখে । আমার বাপিকে চাকরি জীবনে নানা জায়গায় বদলি হতে হয়েছে , আমাদের দুজনের মাঝে কেউ এসেছে তবে তা খুব ক্ষণস্থায়ী। হয়তো আমরা দুজনেই মন থেকে চাইনি বলে, বাপির চিন্তা ছিল কেউ আমাকে না বুঝে যদি কষ্ট দিয়ে ফেলে আর আমার ভাবনা ছিল পাছে কেউ আমার বাপির স্নেহের ভাগ বসায়।
বাপি নিজের পরিবারের সবার সঙ্গে দূরত্ব রেখেছিল এই কারণেই। বাঙালি পরিবারের চিরাচরিত সংস্কার বাপি মানেনি। আমি কলেজে ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হিতাকাঙ্খী সেজে থাকা মানুষজন বাপিকে উপদেশ দিয়েছিলেন মেয়ের বিয়ে দিয়ে দাও যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে। বাপি তাদের বলেছিল "সয়য় হলে নিশ্চয়ই বিয়ে দেবো তবে তোমাদের সময় মেনে নয়"।
আমি বাপিকে বলেছিলাম "বাপি আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। তোমার সান্নিধ্য আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দদায়ক । কি হবে তোমার আর আমার মাঝে অন্য মানুষকে এনে ,কেউ আমাদের দুজনের মাঝে ভালবাসার সেতু হতে পারবে না বরং আমাদের জীবনকে আরো দূর্বিসহ করে তুলবে"।
বাপি বলেছিল "সময়ের অপেক্ষা কর তাড়াহুড়োর দরকার নেই"।বাপির সামান্য কথাতেই আমি ভরসা পেতাম । আজকাল আমার খুব ভালো লাগে বাপির জন্য কোন কিছু রান্না করতে। বাপি চিরকাল নিজের হাতে রান্না করতো এবং মায়ের মত রান্না করতে চেষ্টা করতো যাতে অবেচতন মনেও আমি মায়ের অভাববোধে কষ্ট না পাই ।
আমরা দিল্লিতে ছিলাম বেশ কয়েকবছর সেই সময় বাপির এক কলিগের পরিবার আমাদের খুব ভরসার মানুষ হয়েছিল।
আমরা কোয়াটার থাকতাম ,ময়ূখ আঙ্কেল আমাদের পাশেই থাকতেন। আন্টি ছিলেন ভীষন ভালো মানুষ, মায়ের মত নিজের হাতে আমাকে খাওয়াতেন। আঙ্কেল ও আন্টির ছেলে মেয়ে ছিল না সেই জন্য বোধহয় ওনাদের দূর্বলতা ছিল আমার উপর একটু বেশি।
আমি টুভেলেভে পরীক্ষা দেবার পর আমরা আবার কলকাতায় ফিরে আসি। আমি কলকাতায় থেকে কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করি। বাপি যেহেতু একজন আই .এস অফিসার ছিল তাই বাপি আমাকে আই.এস পরীক্ষার প্রিপারেশন নিতে বলতো। আমি বাপিকে বোঝাতাম "তুমি সারাজীবন দেশের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে গেছো" ।
" আমি ওই জীবন চাইনা, আমি তোমাকে নিয়ে কোন এক জায়গায় স্হায়ী ভাবে থাকতে চাই। বাপি বলেছিল "আমি এবার এক জায়গায়ই থাকবো। তোকে বিয়ে দিয়ে দেবো তারপর তোর সুবিধা মত আসবি তুই"।
বাপি স্নেহের সুযোগ নিয়ে আমি গবেষণায় ব্যস্ত থাকার অজুহাতে বিয়ের কথা তুলতেই দিতাম না। আমি জানতাম বাপি আমাকে ছেড়ে কিছুতেই ভালো থাকতে পারবে না। প্রকাশ করতে না পেরে ভীষন মন কষ্টে অসুস্থ হয়ে যাবে।
আমার রিসার্চ পেপার সামমিট করা হয়ে গেছে সেইসময় হঠাৎ একদিন ময়ূখ আঙ্কেল আর আন্টি আমাদের বাড়িতে এসে হাজির, ওনারা বাবাকে প্রস্তাব দেন আন্টির দাদার ছেলে উচ্চ শিক্ষিত পোস্ট রিসার্চ স্কলার তাঁর সঙ্গে আমার বিয়ের দিতে চায়। বাপি হয়তো মনে মনে চাইছিল চেনাজানার কারুর হাতে আমাকে সমর্পণ করতে।
যাহোক আন্টিরা থাকা কালীন ওনারা এলেন প্রায় বিয়ে কথাবার্তা ঠিক করে উঠে যাবেন তখন আমার মনে হলো আমার বাপি সারাজীবন নিজের কথা ভাবেনি।বাপির এবার বয়েস হয়েছে আমার তো এবার ছাতা হওয়া উচিত বাপির। আমি স্বার্থপরের মত বিয়ে করে বাপিকে একা রেখে চলে যেতে পারিনা। ভেতরটা ডুকরে কেঁদে উঠলো এ আমি কি করছি।
আমি বাপির বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বললাম "বাপি তোমার দোয়ায় তুমি আমাকে পর করে দিওনা। আমি কোথাও সুখী হতে পারবো না তোমাকে ছাড়া। আমার সুখ, আমার দুঃখ, আমার আনন্দ তোমার মেয়ে হয়ে থাকাতেই। আমি তোমার থেকে আলাদা হতে পারবোনা বাপি"।
ওনারা সবাই একটু হতভম্ব হয়ে পরেছিল আমার কথা শুনে। বাপি আমাকে পাশে বসিয়ে চোখের জল মুছিয়ে ওনাদের বলল "আমি খুকি বিয়ে দিতে রাজি একটাই শর্তে আমি কন্যাদান করবো না। খুকি আমার মেয়ে আমারই থাকবে চিরকাল" ।
"সংস্কার মানতে গিয়ে আমার খুকির যেন কখনও মনে না হয় ওর বাবা ওকে পর করে দিয়েছে। তাছাড়া কন্যাদান,বাবা- মায়ের ঋণ শোধ এই সব অযৌক্তিক নিময় মেয়েদের উপর চাপিয়ে আমরা ওদের দিনের দিন মানসিক নির্যাতন দিয়ে যাচ্ছি তাই নিয়ে ভাবার সময় হয়েছে এখন"।
আন্টির বাপের বাড়ির লোকজন একটু সংস্কার মানে ,চিরাচরিত প্রথার বিপরীতে কি সিদ্ধান্ত নেবে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন। সেইসময় 'সমীরণ' আন্টির দাদার ছেলে বলে উঠল "আঙ্কেল আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আপনাকে এইসব ভাবতে হবে না। খুব সামান্য আচর -নিয়ম মেনে রেজিষ্ট্রেশন করে আমাদের বিয়ে হবে"।
"আরেকটা কথা আমি দেরাদুনের কাছে একটি সরকারি কলেজে চাকরি পেয়েছি সেখানে আমাদের বিয়ের পর আপনাকেও গিয়েও থাকতে হবে। তবেই আমি এই বিয়েতে রাজি"। বাপি বলল "আমার তো এখনও কিছুদিন চাকরি আছে , তোমরা আমার কথা ভেবো না"।
ময়ুখ আঙ্কেল বলল "সমীরণ তুই ভাবিস না আমি ওনার বদলির ব্যবস্থা করছি"। সেই মূহূর্তে আমার মনে হয়েছিল সমীরণকে ভগবানের দূত। মেয়েরা তো এইরকম মানুষকেই জীবনের সঙ্গী হিসেবে চায়। যে পাশে থাকবে বলিষ্ঠ সহযোদ্ধা হয়ে। সহমর্মী মানুষ হয়ে সুখে, দুঃখে।
এরপর বাপি আমাদের সঙ্গে প্রায় পনের বছর ছিল , আমি এখানকার কলেজে চাকরি পাই। সমীরণ আর বাপির অদ্ভুত মিল আমার সাচ্ছন্দ্যের ব্যাপারে। সমীকরণে মত মানুষ আমাকে ভাবতে শিখিয়েছে জীবন কত সুন্দর।
পাহাড়ের কোলে বাপি আর সমীরণের সহযোগিতায় একটা বাড়িও হয় আমাদের। বাপি নিজে সখ করে বাগানও করতো। আমার মেয়েকে নিয়ে বাপি খুব খুশি ছিল,তাকে বাপি তাঁর শিক্ষা ও আদর্শবোধ সব শেখাতো। তবু বাপিকে আমার হারাতে হয়েছে ধরে রাখতে পারিনি কালের নিয়মে। হয়তো বাপি ওই মেঘের আড়ালে লুকিয়ে রোজ দেখে এখনও তাঁর খুকিকে।
Comments
Post a Comment