কন্যাদান ( প্রথম পর্ব)
**কন্যাদান ( প্রথম পর্ব)
** কলমে -- অলোকা চক্রবর্তী**
অন্ধকার হয়ে এসেছে অল্প অল্প ঠান্ডা পরেছে কার্তিক মাসের প্রায় শেষ। আজকে তার উপর সারাদিন আকাশের মুখ ভার, টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে মাঝে মধ্যে।
পাহাড়ের পাদদেশে এই শহরের বৈশিষ্ট্য ভোর থেকে মানুষের গুঞ্জন,ব্যস্ততা আরম্ভ হয়ে যায় , আবার সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা ঘাট সব ফাঁকা হয়ে ভীষন রকমের এক নিস্তব্ধতা শুরু হয় আবছা আলো অন্ধকারের খেলায়।
আমি বারান্দায় চেয়ারে বসে সূর্য ডোবার আলোয় সাজা আকাশকে দেখছি। বেশ কয়েক বছর আগে আমার বাপি এইদিনে ওই আকাশে আমাকে ছেড়ে ঠাঁই নিয়েছে। বাপি ছিল আমার জীবনের আলো, আমার বাপি আমাকে একটু একটু করে শিখেয়ে ছিল আত্মসমর্পণ কখনও নয় ,আত্মসম্মান বোধকে নিজের মধ্যে কি ভাবে জাগ্রত রাখতে হয়।
বাপি আমাকে শিখেয়ে ছিল তুমি মেয়ে হয়ে জন্মেছো বলে পারবে না এমন ভাবনা কখনো ভেবো না। তুমি সুস্থ মানুষ অতএব তুমি পারবে এই মানসিকতা সবসময় মনের মধ্যে রাখতে।
আমার তখন দশ বারো বছর বয়েস সেই সময় আমার মা মারা যান । তখন মায়ের চলে যাওয়ার শেষ কটা দিন দেখেছি বাপিকে মায়ের মনোবল বাড়ানোর কি অসম্ভব প্রচেষ্টা, অথচ নিজের ভেতর বাপি ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলো ভালবাসার মানুষকে যে কোন সময় হারিয়ে ফেলার ভয়ে।
বাপির কাছে শুনেছি 'মা' বাপির ছোটবেলার খেলার সঙ্গী, তারপর ভালবাসা, বিবাহিত জীবন। আমার আগমন ঘিরে দুজনের স্বপ্ন রচনার কথা। মা যেদিন মারা যান আত্মীয় স্বজন ভর্তি বাড়ি। সবাই মিলে বলতে লাগলো সন্তানের হাতে মুখাগ্নি নিয়ম, তাই আমাকে সবাই মিলে নিয়ে গেছিল শ্মশানে।
আমি তখন মাকে হারিয়ে হতবাক, তাছাড়া খুব ছোট ছিলাম পরিস্থিতি বোঝার মত মনের ম্যাচিউরিটি হয়নি । আমাকে যখন আগুন ধরিয়ে কাকা মায়ের মুখে দিতে বলল আমি চিৎকার করে কেঁদে ওঠে আগুনের কাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে বাপিকে জড়িয়ে ধরে বলি মাম্মামের কষ্ট হবে বাপি আমি পারবো না।
বাপি তখন নিজেকে খানিকটা সামলেছে,বাপি ছোট কাকার নাম ধরে বলল প্লীজ তোরা আমার খুকীকে আর কষ্ট দিস না। আমি নিজের মধ্যে ছিলাম না তাই খুকিকে এই দৃশ্যের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
ওর এই বয়েসটা হলো মায়ের কোলে বসে থাকার অন্ধ সংস্কার মেনে মায়ের মুখাগ্নি করার নয় তোদের বুঝতে হবে ওর মানসিক অবস্থা।বাপি আমাকে এককোণে নিয়ে গিয়ে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলেছিল মন খারাপ করিস না খুকি, আজ থেকে আমি তোর মা,আমিই তোর বাবা।
এর একমাসের মধ্যে বাপি নিজের চাকরির বদলি নিয়ে সবার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে আমাকে নিয়ে চলে এলো চেনা পরিবেশের বাইরে। হয়তো তখন বাপির জীবনের লড়াইয়ের জন্য পরিবেশ পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল।
এই রকম ভাবে আমার জীবনের একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে বাপি তাঁর নিজস্ব জীবনের চাওয়া পাওয়া গুলো দূরে সরিয়ে আমার বড় হওয়ার কান্ডারী হয়েছিল । বাপি কর্মস্থলে প্রচুর দায়িত্ব সামলে আমার পড়াশোনার খুঁটিনাটি খেয়াল রাখত। আবার মেয়ে বেলার শুরুর মূহুর্তে একজন মা যেমন পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরিবর্তনের আভাস দিয়ে সচেতন করে তাঁর মেয়েকে।
ঠিক সেই ভাবে বাপি আমাকে বুঝিয়েছিল বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের কতটা সাবধানে থাকতে হয়। শ্বাপদের দৃষ্টি আর মানুষের দৃষ্টির ফারাক বুঝে এগিয়ে যেতে হবে মেয়ে জন্মের সার্থকতা খুঁজে।
বাপি বলেছিল ভয় একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায় কারণে অকারণে যখন মেয়েরা নিজেকে আবিষ্কার না করে অন্যের দেওয়া অলংকার আঁকড়ে আমিত্বকে জ্বলাঞ্জলি দেয়। নিজের ক্ষমতা জাহির করার স্পর্ধাও না দেখিয়ে ভাগ্যের দোয়াই দিয়ে মেনে নেওয়াও অপরাধ সৃষ্টির অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করা।
Comments
Post a Comment