বিয়ে নামক ছলনা

*** বিয়ে নামক  ছলনা ***
   
 
আমি নবনীতা  , কয়েকবছর আগেও আমি  হাসি -খুসিতে  থাকতে পছন্দ করতাম  , বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতেও খুব ভালবাসতাম ।তখন  আমি  ইংরেজী তে মাস্টার্স করছি  শেষ বছর আর কয়েকদিন পর পরীক্ষা, সবাই আমরা পরীক্ষার  পড়া নিয়ে খুব ব্যস্ত। আবার বন্ধুদের খুব মনখারাপ সবাই এবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবো এবার তো সবাইকে নিজের নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার লড়াই শুরু করতে হবে ।
      এরই মধ্যে আমার  পিসি বিশাল এক বড়লোক বাড়ি থেকে আমার  জন্য সমন্ধ আনে ,ছেলে ব্যবসা  করে ।  আমার  পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার পর বিয়ের দিন স্থির হয় । ছেলেটা যখন আমাকে দেখতে আসে তাঁর কথাবার্তায় আমার পছন্দ হয় নি এবং ছেলেটা  আমার  থেকে বছর দশেকের বড় হবে।আমি মাকে বললাম আমার  অপছন্দের কথা কিন্তু আমার দাদা বলল  একটা ছেলের প্রতিষ্ঠিত হতে ওরকম একটু বয়েস হয়ে যায় । 
     দাদা বলল বাড়ি, গাড়ি সব আছে তুই রাজরানী হয়ে থাকবি চিন্তা করিস না । আমার  কোন যুক্তি আমার  বাড়ির লোকেরা শুনলো না এক শুভদিনে আমার  বিয়ে হয়ে গেল ,আমি চলে এলাম  শ্বশুরবাড়িতে । এসে দেখি মস্ত রাজপ্রাসাদ কিন্তু বাড়িতে কেউ নেই একমাত্র শ্বাশুড়ীমা আছেন আর গুটি কয়েক কাজের মানুষ।আমার বৌভাত খুব ধুমধাম করে হলো পয়সার দাক্ষিণ্যে, হয়তো বা সবার অজানা কোন রহস্য লুকিয়ে রাখতেই এত চাকচিক্য করে মহিমা প্রচারের দরকার ছিল।
     সবশেষ হয়ে যাবার পর আমাদের ফুলসজ্জা তাই আমি  প্রতীক্ষায় বসে আছি সবকিছু মানিয়ে নিয়ে নতুনভাবে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য‌ হয়তো  কত স্বপ্ন ছিল। আমার  বর এতক্ষণ লোকজনের সামনে হাসিমুখে অভিনয় করছে বুঝিনি ঘরে ঢুকেই বলল আজ খুব ক্লান্ত শুয়ে পড়ো কাল কথা হবে , শুনে আমি অবাক হলাম তবুও চুপচাপ মনখারাপ করে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম নানা ধরনের ভাবনা নিয়ে।
      পরেরদিন সকালে বর বেরিয়ে গেল বলে গেল ফিরতে রাত হবে ।  সারাদিন আমি  একা ,কথা বলার কেউ নেই। শ্বাশুড়ীমাও বৌভাতের পরেরদিন রহস্যজনক কারণে গ্রামের বাড়ীতে চলে গেলেন ছেলের রাজপ্রাসাদ ছেড়ে।
    এইরকম রোজ আমার বর সকালে বেরিয়ে যায় আর  রাতে ফেরে,কোন কোনদিন আমার বর ফিরে এসে আমাকে  জিজ্ঞাসা করে কেমন লাগছে ভালো তো ।আমিও  ঘাড় নেড়ে বলি  হ্যাঁ । বাড়ির কাজের লোকরা খেতে দেয় এরপর আমরা  দুজনে খেয়ে ঘরে চলে আসি  । রোজ  আমার বিয়ে করা বর আমার  সঙ্গে কোন কথা না বলে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পরে আমার অস্তিত্বকে অবজ্ঞা করে। আমার সমস্ত আশা জলাঞ্জলি হওয়ায় আর রোজ এই নির্মম ব্যবহারে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পরতাম  । 
       
এভাবেই রোজ আমার স্বামী সেজে থাকা লোকটার কোন কথা না বলে  ঘুমিয়ে পরা আমার পক্ষে অসহ্য ছিল মানিয়ে নেওয়া, খুব আত্মসম্মানে লাগতো। চুড়ান্ত অপমানিত বোধ হতো আমার নারীত্বের অবমাননায়।অষ্টমঙ্গলায় কিছুক্ষণের জন্য আমার সঙ্গে আমার বাপের বাড়ি গেছিল একগাদা উপহার সামগ্রী নিয়ে ।দুপুরে খাবার পর কাজের অজুহাতে আমাকে নিয়ে চলে আসে ।
একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে এড়িয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন এর থেকে অপমান আর কিছু হয়না।

 ছয় মাস বিয়ে হয়েছে না পেলাম স্বামীর ভালবাসা না পেলাম না পেলাম আমার নারীত্বের সম্মান।শ্বশুরবাড়িতে কোন কাজ করতে হয় না যেমন ঠিক তেমন এখানকার প্রাচুর্যের মধ্যে  আমার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠলো ।কোন মানুষ পারে না দিনের পর দিন শুধু শাড়ি গহনা নিয়ে থাকতে, কারুর সঙ্গে কথা বলবো সেরকম কেউ নেই । ভালবাসা হীন সম্পর্ক টেনে নিয়ে যেতে আমার মন বিদ্রোহ করতো সর্বক্ষণ। আমার কিসের দায় সামাজিক দায়বদ্ধতা মানা,যে বিয়ে একটা ছলনা তার ভার আমি কেন বইবো। আমি ভুলতে চাই আমার বিবাহিত এই কথাটা।

যে মানুষটির সাথে বিয়ে হয়েছে সে সম্পূর্ণ অন্যরকমের মানুষ  আমি তো তাকে বোঝার সুযোগ পাইনি তবে আমার বিশ্বাস লোকটা অবৈধ কোন সম্পর্কে জড়িত তাই লোকচক্ষুর সামনে আমাকে বউ সাজিয়ে উপস্থিত করেছে নিজের দোষ ঢাকতে।  ওই লোকটার মধ্যে আমার জন্য কোন ভালবাসা নেই বুঝেছিলাম ওর ব্যবহারে। এই কয়েকমাসে ব্যস্ততার অজুহাতে আমাকে এড়িয়ে যেতে দেখে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম। ওর না মন আছে একটা মেয়ের অনুভূতি বোঝার --না আছে ভালবেসে দুটো কথা বলার সময় নেই এতটাই মুখোশধারী‌‌ ওই‌লোকটা। এই কয়েক মাসে কটা কথা হয়েছে গুণে বলা যায় ,অনেকসময় আমি এগিয়ে গেছি কথা বলতে কিন্তু তাঁর দিক থেকে কোন সারা না পেয়ে পিছিয়ে এসেছি অসম্মানিত হবার ভয়ে।

  শুধু বেরোবার সময়  কিছু টাকা আমার হাতে দিয়ে বলতো কিছু খাবার ইচ্ছা হলে  বা কিছু দরকার হলে আনিয়ে নিও। ভাবতো হয়তো টাকা দিলেই আমি খুব খুশি হবো।যে মানুষ বিয়ের নামে ছলনা করে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে তাঁকে কিছুতেই ক্ষমা করা যায় না।তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এই  বড়লোক বাড়ির বৌ হয়ে জীবন কাটিয়ে আমি আমার  জীবনকে নষ্ট করবো না ।  
কাজের লোককে  বলে বাপের বাড়িতে চলে এসেছিলাম । সেইদিন রাত্রিবেলাতেই লোকটা আমাদের বাড়িতে চলে আসে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে ,তখন আবার সেই মুখোশ পরে মিষ্টি কথা , কি নম্র ব্যবহার।

প্রথমে আমি উনার সঙ্গে দেখা করতে চাইনি মনের বিতৃষ্ণায় ,তারপর বাড়ির লোকরা জোরাজুরি করায় দেখা করি  তখন বলে এইরকম করে চলে আসতে হয় --আমাকে বললেই আমি নিয়ে আসতাম।চল ফিরে চল বাড়িতে --- আমি শক্ত হয়ে বলি আমি ফিরে যাবার জন্য তো আসে নি । আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আর ফিরে যাবো না,  আমার  একা একা  থাকতে  ওই বদ্ধ চারদেওয়ালে  দমবন্ধ হয়ে আসে । এই একমাসে  কোথাও বেড়াতে যাওয়া তো দূরস্থান তোমার  আমার জন্য একঘন্টা সময় হয়নি দেওয়ার । 
আমি তো পুতুল নয় রক্ত মাংসের মানুষ তোমাকে বুঝতে হবে এটা।
বলল আমার তর্কাতর্কি করতে ভাললাগে না, আর সত্যি আমি ব্যবসা নিয়ে একটু ব্যস্ত থাকি । তোমার তো কোন অভাব রাখিনি।
আমি বললাম আমার প্রয়োজনীয়তা কিসের, তুমি তোমার ব্যবসা নিয়ে থাকো  আমাকে আমার মতো করে থাকতে দাও। আমার যা শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে ওই টাকা আমি নিজেই রোজগার করতে পারবো তারজন্য কারুর বউ সেজে থাকার দরকার নেই।
এবার লোকটা উঠে বলল এটাই তোমার শেষ সিদ্ধান্ত ।আমি বললাম হ্যাঁ এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত ।
এরপর  উঠে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ চলে গেল। আমার বাড়ির লোকরা বলতে লাগল এটা তুই ঠিক করলি না ।খালি বাবা আমার মনের অবস্থা বুঝে বললেন জীবন তোমার --সিদ্ধান্তও  তোমার।

কয়েকদিন পর  এক পুলিশ অফিসার আমাদের বাড়িতে এসে বললেন আমার তথাকথিত স্বামী নাকি অভিযোগ করেছে যে আমাকে যে গয়না গুলো দিয়েছে সেগুলো  সে ফেরত চায় ।
 
আমি পুলিশ অফিসার কে বললাম একটু দাঁড়ান আমি তৈরি হয়ে আসছি , আমি বাবা ,দাদাকে  নিয়ে পুলিশ অফিসারের সঙ্গে আমার‌ মুখোশধারী স্বামীর বাড়িতে গেলাম ,আমি জানতাম এই দুপুরের খাবার সময় লোকটা বাড়ীতে আসে । 

 আমি সোজা ওর সামনে গিয়ে বলাম  ঘরে চলো  আমার সঙ্গে পুলিশ অফিসার, বাবা ,আর দাদা। ওর ঘরে ঢুকে আমি ওকে আলমারির লকারটা খুলতে বললাম তারপর একটা লাল ব্যাগ বার করে খুলতে বললাম। ব্যাগ খুলতেই লোকটার দেওয়া সব গয়না আর  যতটাকা আমাকে দিয়েছিলেন সব  বেরিয়ে গেল ।

লোকটা টাকাগুলো নিয়ে অবাক চোখে আমার দিকে তাকাল ,আমি বললাম এইগুলো সেইসব টাকা যেগুলো তুমি আমাকে খরচ করার জন্য দিয়েছিলে কিন্তু আমি মনের বিতৃষ্ণায় একটা টাকাও খরচা করিনি। বাবা বলল পুলিশকে না জানিয়ে ফোন করলে তো নবমিতাই বলে দিত কোথায় আছে গয়না গুলো।
তাছাড়া আমরাও তোমাকে অনেক গয়না দিয়েছি সেগুলো তো আমরা ফেরত চাইনি । ওনি বললেন এখনি দিচ্ছি বলে গলা থেকে হার ,আংটি ,বোতাম ফেরত দিল ।বাবা ওগুলো ফেরত নিচ্ছিলেন না, দাদা বলল দাও অপাত্রে দান করে লাভ নেই ।

আমি কিছু না  বলে শুধু বাবাকে চলো বলে চলে বেরিয়ে এলাম । এইরকম ব্যবহারে ভীষণরকম ভাবে মানসিক বিপর্যস্ত হয়ে পড়লাম তবুও মনকে শক্ত করে বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় বসতে লাগলাম । 
 একবছর নানা মানসিক যন্ত্রণা সহ্য  করে বন্ধুদের সহানুভূতি,বাড়িরলোকের সহায়তায় আমি  চেষ্টা করে একটা কলেজে চাকরি পেলাম । এরমধ্যে লোকটা আবার হয়তো কোন মেয়ের সর্বনাশ করার জন্য ডিভোর্স পেপারে পাঠিয়েছিল আমিও সই করে পাঠিয়ে দিয়েছি । এখন আমি নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখি , নতুনকরে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি মুখোশধারী অমানুষদের মুখোমুখি লড়াই করার।

Comments

Popular posts from this blog

আমার স্বপ্নের ঘর

মল্লিকাঅর্জুন ( চতুর্থ পর্ব)

আমি সেই মেয়েটা