জবানবন্দী (২য় পর্ব)


** জবানবন্দী (২য় পর্ব) **


আমি খুব অল্পতেই খুশি হই আমার চাহিদা কোনদিনও আকাশ ছোঁয়া ছিল না ।আমার মনে হয় প্রত্যেক মানুষের মনে একটা স্বপ্ন পূরণের খিদে থাকার দরকার,  অবচেতন মন যা স্বপ্ন দেখে তাকে পূরণ করার খিদে। কিন্তু আমার মত সাধারণ মেয়েরা বেশীরভাগই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে কোনকিছু গভীরভাবে ভাবেনা। তাই নিজের চাওয়া পাওয়ার হিসেবের ধারাপাত আমাদের বোধগম্যের বাইরে থাকে। গভীরভাবে আছন্ন থাকি যা পেয়েছি এইটুকুরই কি আমি যোগ্য? । হয়তো এই চিন্তাধারার বাহক বলেই আমরা সাধারণ মেয়েরা মনের আত্মিক বন্ধনে গেঁথে রাখতে পারি পরম্পরায় একটা ছাদের তলায় বিভিন্ন মানুষকে মানসিকতা আলাদা হলেও।
 আমরা বেশী ঝামেলা পছন্দ করিনা, আমরা বিশ্বাস করি যেটা আমার পাওনা তা আমি পাবোই । জোর করে নিজের অধিকারের প্রতিষ্ঠিত করতে মন চায় না, হয়তো প্রবল আত্মসম্মানবোধ এবং আত্মাভিমানের জন্য। 
 
যেকোন মানুষের আমরা জানি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তৈরী হয় বেড়ে উঠার পরিবেশ থেকে আর কিছুটা পরিস্থিতি মানুষের স্বভাবকে পাল্টে দেয়।
আমি আমার মাকে দেখেছি খুব সম্ভ্রান্ত পরিবারের একমাত্র কন্যা সন্তান, ততটাই সুন্দরী,গায়ের রং ধবধবে সাদা কিন্তু স্বভাব ভীষন মার্জিত, মায়ের মধ্যে কোন অহংকার ছিল না। মা সবকিছুতেই কেমন নির্লিপ্ত ছিলেন। আমার মায়ের কোন আক্ষেপ, কোন অভিযোগ কোন দিন শুনিনি বরং সমস্ত সময় হাসিমুখে আমাদের সবাইকে আগলে রাখতেন পরম মমতায়,স্নেহে। মায়ের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ করায়ত্ত করতে না পারলেও কিছুটা নিজের অজান্তে জড়িয়ে নিয়েছি তাই হয়তো আমার মত সাধারণ মেয়ের চলার পথের চড়াই-উতরাই আজ অনেক সহজ হয়েছে। 
 
আমি মনে করি প্রত্যেক মানুষই স্বতন্ত্র তাঁর নিজস্বতা নিয়ে তাই  কাউকে ভালমন্দের বিচার করার আগে দেখা উচিত ওই মানুষটার বিবর্তনের ইতিহাস । জানি কিছু মানুষ থাকে বিচারের উর্ধ্বে,এরা নির্লজ্জ মিথ্যাচার করে নিজেদের স্বার্থের জন্য এরা করতে পারে না এমন কোন কাজ নেই। আমরা স্বাধীনতার যুদ্ধের ইতিহাসে জানি আমাদের দেশের মানুষ টাকার লোভে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিল বলেই কত কঠিন হয়েছিল স্বাধীনতার লড়াই। এখনও সমাজের আনাচে- কানাচে এই স্বার্থলোভী মানুষেরা মুখোশ পরে লুকিয়ে আছে ভালো মানুষ সেজে । এই সব মানুষের জন্য মানুষের বিশ্বাস আজ ধূলায় লুন্ঠিত হয়ে গেছে।‌ অবিশ্বাসের চারাগাছ আজ সকলের মনেই অল্প- বিস্তর ডালপালা ছড়িয়ে আছে।

জীবনের শেষবেলায় এসে আমার মনে হয় কেন মানুষে মানুষে এই হানাহানি কেন এই জাতপাতের ভেদাভেদ, কেন রাজনীতি লড়াই ,কেন এত বৈষম্য মানুষের মধ্যে। এগুলো তো কোন দেবতার তৈরী নয় এইসব সমাজের কিছু সুবিধাবাদী মানুষ নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে সমাজের মানুষকে বিভ্রান্ত করে ভুল ভাবনা ভাবতে বাধ্য করছে। এই রকম ভাবনার ভিত এতো মজবুত  মানুষের মনে  রক্ত সংগ্রহ করতে গিয়েও মানুষ ভাবছে তাঁর প্রিয়জনের  শরীরে কার রক্ত নিচ্ছে হিন্দুর না মুসলমানের,,?। জানি না এই ভাবনা হয় না কেন মানুষের-- এটা কোন নেশা খোরের রক্ত নয় তো কিম্বা কোন দূরারোগ্য ব্যাধির জীবাণু যাচ্ছে না তো আমার প্রিয়জনের শরীরে।

 হাসপাতালে গিয়ে যখন আমরা প্রিয়জনের প্রাণ ভিক্ষার জন্য ডাক্তারের হাতেপায়ে ধরি তখন কি এই চিন্তা মাথায় আসে ডাক্তার বাঙালি না অবাঙালী না সে হিন্দু না মুসলমান। আমরা তাঁকে ভাবি "ভগবান" যাঁর উপর আমাদের প্রিয়জনের অস্তিত্ব নির্ভর করছে ,এই ভাবনা শুধু কেন বিপদের সময় ?কেন নয় জীবনের প্রত্যেকটা পদক্ষেপে। হয়তো অনেকেই ভাবছেন অবান্তর ভাবনা আমার , সত্যি কি তাই আপনি যখন একান্তে সময় কাটান তখন কি মনে হয়না আপনার এইটুকু সময় বাঁচার জন্য কেন এতো হানাহানি, কেন এত দোষারোপ।তার চেয়ে সবাই মিলেমিশে ভালো থাকি। কি জানি আমার সাধারনত্ব হয়তো  আমাকে এইরকম ভাবনা ভাবায়। আমরা সবাই জানি সংকটময় মুহুর্ত যখন আসে দেশে, শহরে ,গ্রামে -তখন কিন্তু বিবেক সম্পন্ন প্রত্যেকটা সম্প্রদায়ের মানুষ একসাথে লড়াই করে নিজের দেশ, নিজের শহর , নিজের গ্রামকে রক্ষা করতে। আমাদের অবস্থান একসময় যেখানে ছিল আজ সেখানেই  নেই। এখন সভ্যতা ও শিক্ষার হাত ধরে অনেকটায় আমরা এগিয়ে যাচ্ছি , ভবিষ্যতে আরও এগোব --এই ভাবনার সুখ অনুভূতি নিয়ে বলবো মনের ক্ষুদ্র গন্ডী ভেঙ্গে ফেলার সময় হয়েছে " সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই"  এটাই একমাত্র ধ্রুব সত্য হয়ে থাক চিন্তনে, মননে।

এবার আমার কথা বলি আমার কিছু ছেলেমানুষী আছে -- আমি একা একা আকাশের দিকে তাকিয়ে কল্পনায় ভেসে যেতে ভালবাসি। আমার ওই অশরীরী আত্মা ওইসবে ভয় নেই, হ্যাঁ আমি সাহসী নয় ভীতু সেটা আমার প্রিয়জনদের চিন্তায়,রক্ত দেখলে আমি ভয় পাই ,ভয় পাই কারুর বিপদের খবর পেলে, কারুর শরীর খারাপ হলে। আবার আমার ভালো লাগে গভীর রাতে সবাই যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে তখন নিঃস্তব্ধ পরিবেশে  বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে চুপচাপ আকাশে দিকে তাকিয়ে,তখন আমি আমার আমিত্বকে খুঁজে পাই একান্ত ভাবে। 

আমি তখন মাধ্যমিক দেবো আমাদের দোতলার একটা ঘরে আমি একা থাকতাম পড়ার জন্য। কোন দিন রাত একটা ,কোন দিন দুটো বেজে যেত আমি তখন লাইট অফ করে জানলায় দাঁড়িয়ে থাকতাম বেশ কিছুক্ষণ। আমাদের বাড়ির সামনে রাস্তাটা তখন একদম চুপচাপ । ওই সময় আমার মনে হত আকাশ,বাতাস , রাস্তা, গাছেরা সবাই একসঙ্গে সারাদিনের ওদের অভিজ্ঞতার গল্প করছে। ওই সময়টা মানুষের সব সভ্যতা থমকে থাকে ওরা নিজেদের মত করে সময় কাটায় নিরিবিলি পরিবেশে এইরকম ভাবনায় বহুরাত কাটিয়েছি আমি।

 আজও যখন কোন কিছুতে মন খারাপ হয় ঘুম আসে না আমি তখন চুপচাপ চোখের জলে আকাশের কাছে প্রকাশ করি আমার অভিমান, আমার না বলা সব যন্ত্রণার কথা। আমার ইচ্ছাকৃত নয় তবুও আমার কোন কাজে কেউ কষ্ট পেলে সেই যন্ত্রণার কথা নিরবে আকাশের কাছে প্রকাশ করি। আমি ভালবাসায় জড়িয়ে নিয়ে চলতে ভালবাসি। আমি আমার প্রিয়জনদের উজাড় করা ভালবাসা, সম্মান সব পেয়েছি তবুও কখনও আমার সাধারণত্ব কাউকে আঘাত দেয়ার কারণ হয়ে যায় আমার সঠিক বোঝার অক্ষমতায় । আমার আমিত্ব তখন অব্যক্ত ভাষায় দিশেহারা হয়ে চোখের জলকে অবলম্বন করে। হয়তো এই গল্প আমার মতো সব সাধারণ মেয়ের জীবনে ঘটে, আমরা সাধারণ মেয়েরা সবসময় সবাইকে বোঝাতে পারিনা তাই দোষের ভাগী হয়ে যাই । আমাদের ঘাটতি নিয়ে সমালোচনা করার অনেক মানুষ আছে কিন্তু সঠিক বোঝার মানসিকতা নেই তাই আঙ্গুল উঠে সহজেই ।   ভুলগুলো শুধরে নেয়ার সময় বোধহয় চলে গেছে। তাই ইচ্ছে হয় আরেকটা জন্ম হোক আমার, নতুন জন্মে আমি সাহসী হবো, আমি প্রতিবাদী হবো, আমি তুখোড় মেধাবী হবো, আমি গোছালো হবো। আমার এজন্মের সব ঘাটতি গুলোকে দূর করে এই জন্মের ইতিকথার শেষে এক অসামান্য মেয়ে হয়ে জন্ম নেবো।




Comments

Popular posts from this blog

আমার স্বপ্নের ঘর

মল্লিকাঅর্জুন ( চতুর্থ পর্ব)

আমি সেই মেয়েটা