অভিনব প্রতিশোধ ( শেষ পর্ব)
**অভিনব প্রতিশোধ ( শেষ পর্ব) **
** অলোকা চক্রবর্তী **
তারপর নমিতার কথামতো ওর ওখানে কয়েকদিন থেকে বাড়িতে চলে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার আগের কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার নিজে এসে আমাকে অনুরোধ করলেন "নন্দিনী" "তুমি আবার আমাদের কলেজে এসে যোগ দাও , তোমার অভাব কলেজে ভীষন বুঝতে পারি"। ওনি আমাকে আশ্বস্ত করেন ওনার উপরমহলে জানাশোনা আছে আমি চাইলেই ওনি ব্যাবস্থা করে দেবেন। স্যারের কথা শুনে মুখের উপর কিছু বলতে পারছি না ওনি বয়েস্ক মানুষ তবু বললাম স্যার আমার পক্ষে আর সম্ভব নয় বাড়ি ছেড়ে আসা। আমাদের বাড়িটা একদম ফাঁকা পরে আছে ,-- আমার কথা শুনে নমিতা আমাকে ধমকে বলে উঠল "তুই চুপ কর --"নন্দিনী"-- তুই কি ভেবেছিস তোকে আমরা আবার ছেড়ে দেবো -- যেখানে তুই ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকিস",-- আমার আগের কলেজের কয়েকজন কলিগ প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে এসেছিলেন তাঁরা নমিতা সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলে উঠল-- "না , না--"নন্দিনী"--তোমার যাওয়া চলবে না --- আমরা সবাই আছি তো-- একসাথে পরিস্থিতির মোকাবিলা করবো"।
যাহোক ওদের সবার জোড়াজুড়ি এবং আন্তরিক অনুরোধে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ওখানকার পাঠ চুকিয়ে এই কলকাতায় পাকাপাকি ভাবে থাকবো তাই বাড়িতে গেলাম কিছু কাজ সারতে । আমাকে ওরা একা ছাড়লো না --আমার কলেজের দুজন কলিগ ও নমিতা সঙ্গে এলো। তবে আমার কলিগরা বাড়িতে এলোনা ওরা হোটেলে থাকলো বলল মফস্বলের মানুষেরা ছেলে- মেয়েদের এই বন্ধুত্ব ভালো চোখে নেয়না -- কি হবে শুধু শুধু মৌচাকে ঢিল ছুঁড়ে-- ।
আমি বাড়ির দায়িত্ব আমাদের পুরনো লোক অবনীদা আর বৌদিকে সব বুঝিয়ে মোটামুটি তিন দিনের মধ্যে কাজ শেষ করলাম। সেইদিন কলকাতায় ফেরার ট্রেন রাতে সকালবেলা চা খেয়ে আমরা কথা বলছি ভগবান দা তখন বাজারে গেছে হঠাৎ বাইরের দরজায় ভীষন জোর আওয়াজ হলো-- আমি আবার ভয়ে কেঁপে উঠলাম-- নমিতা আমার দিকে চেয়ে বলল "বোধহয় জোরে হাওয়া দিচ্ছে ভয় পাসনা" --ইতিমধ্যে ভগবান দা এসে বলল "দিদিমণি ওইরকম হাট করে কে দরজা কে খুললে" -- আমি আর নন্দিনী মুখ চাওয়া চাওয়ি করে ভাবছি -- কি ঘটছে আবার--।
তখন নমিতা ঘরে বাইরে চারিদিকেটা দেখে এসে দরজা বন্ধ করে কাউকে ফোন করে বলল রেডি -'সময় হয়ে গেছে'। তারপর দরজা খুলে আমার পাশে এসে বলল "আর কতদিন এইভাবে নিজেকে কষ্ট দিবি "নন্দিনী"। একবারও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছিস নিজের চেহারাটা"। এইরকম নানা কথাবার্তায় বেশ কিছুক্ষণ সময় চলে গেছে খেয়াল করিনি তখন বারোটা বাজবে ভগবানদা এসে বলল দিদিমণি বাড়িতে পুলিশের গাড়ি, মনে হচ্ছে আমাদের পুরো বাড়িটা পুলিশ ঘিরে রেখেছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম সেকি !-- কেন-- ?।
নমিতা বলল "চল গিয়ে দেখি"-- ঘরে বাইরে আসতেই দেখলাম অনেক পুলিশ উপরে যাবার সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল।কি হচ্ছে আমি কিছু বুঝতে পারছি না-- ভগবানদাও ভয় পেয়ে বারবার আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে--- কিছুক্ষণ পর পুলিশ উপর থেকে যাকে নিয়ে নামল তাকে দেখে আমি হতবাক-- নমিতা আমাকে ঝাঁকিয়ে বলল "এবার চোখ খুলে দেখ যার জন্য চোখের জল ফেলেছিস এতদিন সে বহাল তবিয়তে আছে আর তোকে ছদ্মবেশ ধরে ভয় দেখাচ্ছিল নিজের কুকর্ম যাতে না ধরা পড়ে । "ও" শুধু তোর সঙ্গে প্রতরণা করেনি আমার, বিমানের জীবনটাও ছারখার করছে। একটা শিক্ষিত মানুষের কি জঘন্য কারসাজি , এতটা নিচে কেউ নামতে পারে ভাবতে পারছি না"। তখন পুলিশ অফিসার বলল "ম্যাডাম" "আপনাকে একবার থানায় আসতে হবে। মনে হয় একবার এলেই আপনার সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন"। নমিতাই আমার হয়ে উত্তর দিল "আপনারা এগোন অফিসার আমরা আসছি"।
আমি ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছিলাম না অভিনব নিজের জীবন , নিজের ক্যারিয়ার,আমাদের এতদিনের ভালবাসা সব জলাঞ্জলি দিয়ে এই কাজ কেন করলো ?।
কিছুক্ষণ পর নমিতা আমি থানায় পৌঁচ্ছালাম, আমি তখন অনেকটায় ধাতস্থ আকস্মিক ঘটনার জের সামলিয়ে । পুলিশ অফিসারকে বললাম "ওর সঙ্গে কি কথা বলতে পারি আমি"--?,পুলিশ অফিসার মাথা নাড়তেই আমি ওর কলার ধরে বললাম "আইন আইনের পথে চলুক কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দাও-- কেন এইরকম কাজ করলে বলো ?-- জবাব তোমায় দিতেই হবে --। মানুষের বিশ্বাস আর ভালবাসা নিয়ে ছেলেখেলা করার অধিকার তোমার নেই "অভিনব" ! "। কেন তুমি এতো নিষ্ঠুর মানুষ,---? তোমাকে চিনতে আমার এতো ভুল হলো"--।
আমার পাশে নমিতা এসে বলল "তোকে যখন ফোন করেছিলাম মনে আছে সেই সময় ওই হাসি শুনে আমার সন্দেহ হয়। আমি তোকে কিছু না বলে আমার মেসোমশাই লালবাজারের অফিসার তাকে সব বলি ।ওনি সব শুনে তোদের এখানকার থানায় ফোন করে সব ঘটনা বলে এবং তোদের বাড়ির উপর নজর রাখতে বলে। আসলে নন্দিনী অভিনব তোকে খুব ভালোবাসলেও তোকে ভরসা করতে পারেনি। তোর সঙ্গে বিমানের তোদের বাড়িতে আসাটা ওর পছন্দ হয়নি,অভিনব ভেবেছে বিমান তোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চাইছে হয়তো ওর দূর্বলতা আছে তোর উপর।তাই মনে মনে প্রতিশোধ নেবার জন্যই নানা অছিলায় আমাদেরকে দার্জিলিং নিয়ে যায়। তারপরের --ওখানকার ঘটনা তোর কিছু অজানা সেটা তুই অফিসারের মুখেই শোন"।
অফিসার বলল "আমরা বিমানবাবু ও ওনাকে জিজ্ঞাসা করে এবং তদন্ত করে যা জেনেছি সেদিন ম্যালে গিয়ে ওনি বিমানবাবুকে বলেন "তুই একটু বস আমি আসছি"।একটু পরে ওনি ফিরে একটা ফ্রুট জুসের বোতল বিমানবাবুকে দিয়ে বলেন "তোর আবার এইসব চলবে না। তুই বরং এটা খা, --আমিও একটু আজ মনের আনন্দে খাই।ওই ফ্রুট জুসের ভিতর এমন কিছু মিশিয়ে ছিলেন অভিনববাবু যেটা খেয়ে বিমানবাবু জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তখন অভিনব বাবু মদের বোতলের মদ বিমানবাবুর গায়ে ছড়িয়ে , নিজের একপাটি জুতো রেখে আগের থেকে ঠিক করে রাখা গাড়ি করে বাগডোগরা যান। পরেরদিন যখন আপনারা ওনার অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে বিমানবাবুকে দোষী ভাবছেন তখন ওনি বাগডোগরা থেকে কলকাতা হয়ে লন্ডনে পারি দেন। ওনি খুব ঠাণ্ডা মাথায় গুছিয়ে এইকাজ করেছেন"।
"তবে হয়তো আপনাকে ভুলতে পারেননি তাই পাঁচ বছর পর কলকাতায় ফিরে আপনাকে না পেয়ে এখানে আসেন আপনাকে দেখতে-- তখন থেকেই আপনার উপরে ওনি নজরদারি করছেন। ওনি খুব বুদ্ধিমান মানুষ ওনি জানেন ওনার এইকাজ আপনি সমর্থন করবেন না। তাই মোবাইলে নিজের গলা বিকৃত করে সেটা রেকর্ড করে কথা গুলো শোনাতেন যাতে আপনি ভয় পেয়ে আর অন্য কিছু না ভাববেন" --ওনার বিশ্বাস ছিল আপনি বাড়িতে ফিরে এলেই--ওনি আপনাকে বুঝিয়ে-- না হলে ভয় দেখিয়ে আপনাকে সঙ্গে নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেবেন-- সেই ব্যবস্থাও করে এসেছিলেন যারজন্য তখন গা ঢাকা দিলেও আবার ফিরে এসেছেন -- কিন্তু নমিতা ম্যাডামের সন্দেহ হওয়ায় ওনি আপনাকে একা ছাড়েননি এবং আমাদের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রেখেছেন তাই সহজে আজ ওনাকে আপনার সামনে আমরা আনতে পেরেছি"।
আমার শুনে মনে হচ্ছে মানুষের মন এতো নিচু হতে পারে-- যে নিজের ভালবাসার মানুষকে বিশ্বাস করে না, নিজের এতদিনের বন্ধু তাঁকেও বিশ্বাস না করে এইরকম প্রতিশোধ নিতে পারে।কি রকম মানুষ এরা-- অভিনবের দিকে তাকিয়ে বললাম ---"এর নাম ভালবাসা তোমার?, --তুমি নাকি শিক্ষিত ভদ্র মানুষ---অগ্যাত পান্ডিত্য তোমার যা তুমি দেশ-- বিদেশের ছাত্রছাত্রীদের দান করতে।--- তোমাকে ভালবাসার মাসুল তো আমি দিয়েছি অলরেডি অসহ্য মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থেকে, --গত পাঁচ বছর ধরে আমি বেঁচেও মরে ছিলাম।বিমান ও নমিতার একই অবস্থা তাদের বন্ধুকে বিশ্বাস করে একজন জেলের ভিতর সব সম্মান হারিয়ে আধমরা হয়ে, আর নমিতা জেলের বাইরে অমানসিক যন্ত্রণা নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত কাটিয়েছে পাঁচ বছর ধরে" । "সেইসময় গুলোতে তুমি হয়তো প্রতিশোধ নেয়ার আনন্দে শ্যাপনের ফোয়ারা ছুটিয়েছো । আমার এখন তোমার দিকে তাকাতেও ঘেন্না হচ্ছে ছিঃ ছিঃ"।
নমিতা আমার কাঁধে হাত রেখে বলল--" নিজেকে সামলা "নন্দিনী"।এইসব মানুষের জন্য আর ভাবিস না,--আইন ওর ব্যবস্থা করুক। -- তারচেয়ে চল আমরা সবাই মিলে বিমানকে ওর হারিয়ে যাওয়া সম্মান ফিরে পেতে সাহায্য করে ওকে আবার সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে দিই"। আমি বললাম "হ্যাঁরে" "আমি তোদের সাথে আছি এটাই এখন আমার প্রায়শ্চিত হবে একটা অমানুষকে ভালবাসার"--।
** (শেষ)**
Comments
Post a Comment