একটি মেয়ের উত্তরণের গল্প (৯ম পর্ব)

** একটি মেয়ের উত্তরণের গল্প ( ৯ম পর্ব)**


আজকে সকাল থেকে বৃষ্টি পরছে এইরকম মেঘলা দিনে মেঘ আর বৃষ্টির খেলা দেখতে দেখতে   মনটা আনন্দের জন্য খুব খারাপ লাগছে , অনেকদিন হয়ে গেল একা আমি, আনন্দকে ছাড়া আর ভালো লাগছে না   । হাসপাতাল থেকে এসে কিছুক্ষণ আমি গোপালের পড়াশোনা নিয়ে বসেছিলাম । এখন গোপাল ঘুমিয়ে পরেছে, গোপালের প্রশ্নগুলো আমার আরও মন খারাপ করে দিয়েছে । গোপাল আমার আর ওর ঠাকুমার কথা শুনে বুঝে গেছে বাবার আসতে এখন দেরী আছে ।  হয়তো ওর শিশুমন সবকথার মানে বুঝতে পারেনি, তাই আমার কাছে বারবার জিজ্ঞাসা করছিল বাবা কেন এখন আসবে না । 

আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম বাবার কাজ পরে গেছে তারজন্য কয়েকদিন দেরী হবে আসতে । তুমি মন খারাপ করো না তাহলে বাবারও মন খারাপ হয়ে যাবে জানতে পারলে। গোপাল আমাকে বলল তুমি বাবাকে বলো না  মামনি আমি আর মন খারাপ করবো না । আমি ওকে আদর করে বললাম এইতো আমার গোপাল সোনা ছেলে । গোপাল ওর ঠাকুমাকে আমার মত মা বলে ডাকে আর আমাকে মামণি বলে । গোপালের ঠাকুমা নাতিকে নিয়ে ভুলে থাকতে চেষ্টা করে ছেলেকে  কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণা।
গতকাল আনন্দের একটা চিঠি এসেছে তাতে আনন্দ জানিয়েছে ও  ব্যারিস্টারি পাশ করার পর নিজের অভিজ্ঞতা বাড়াতে যে কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিল সেই কোম্পানি    ওকে অনুরোধ করেছেন আরো ছমাস থেকে যেতে তারপর ওই কোম্পানির ভারতবর্ষে যে ব্যবসা আছে তার আইনজীবী হিসেবে আনন্দকে দায়িত্ব নিতে  । যদিও এই প্রস্তাব আনন্দের জীবনে বিরাট সাফল্যের মাইলফলক, হয়তো ওকে সাফল্য চূড়ায় পৌঁচ্ছাতে সাহায্য করবে। কিন্তু আমার মন খারাপ হয়ে গেছে,আমার অবুঝ মন ভারাক্রান্ত হয়ে আছে কালকে চিঠিটা পড়ার পর থেকে। 

আমার জীবনের ভালবাসার অনুভূতি সবটাই আনন্দকে ঘিরে। ভালবাসার কেমন হয়, তাঁর প্রতি  দায়িত্ব ,কর্তব্য কতটা সচেতনতা বোধ সবকিছু আমি আনন্দের সাহচর্যে শিখেছি। যখন বিয়ে হয় মাত্র বারো বছরের একটা মেয়ে  আমি কতটুকু বা জানার পরিধি। কিছুই আমি বুঝতাম না ,শুধু আনন্দকে ভাললাগত ,এই ভাললাগা আস্তে আস্তে কখন গভীর ভালবাসায় পরিণত হয়েছে নিজেই বুঝতে পারিনি। 
 আনন্দ তখন  কলেজে পড়ে কিন্তু আমার থেকে ওর জ্ঞানের পরিধি ছিল অনেক । অদ্ভুত সহানুভূতি ছিল ওর, আমাকে প্রতিটি পদক্ষেপে ও সাহায্য করত। সেইজন্যই হয়তো নির্ভরতাও ছিল খুব বেশি ,আনন্দ সহমর্মিতা আমাকে বোধ দিল মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে সমাজে মেয়ে বলে পিছিয়ে থাকলে চলবে না ।এইভাবে একটু একটু করে আমি অনেককিছু জানলাম, নিজেকে কিভাবে  পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয় শিখলাম ।
 
 আমি যখন প্রথম কলকাতার স্কুলে ভর্তি হলাম ওর খুব ভয় ছিল আমি কলকাতার সহপাঠিনীদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবো কিনা সেইজন্য বেশ কিছুদিন আমাকে পৌচ্ছে স্কুলের বাইরে অপেক্ষা করতো । আমি বেরিয়ে অবাক হয়ে যেতাম বলতাম তোমার কলেজ কামাই করে এখানে এইভাবে রয়েছো। আনন্দ বলতো বিনু আমার যে ভীষণ ভয় করে তোমার সহপাঠিনীরা যদি তোমাকে গ্রামের মেয়ে বলে অপমান করে, তোমাকে তাদের সমগোত্রীয় না ভেবে দূরে সরিয়ে রাখে তাহলে তুমি তো ভীষণ কষ্ট পাবে মনোবল ভেঙ্গে গেলে কীভাবে পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যাবে ।

তখন আমি আনন্দকে বলি তুমিই তো আমাকে শিখিয়েছ নিজের অধ্যাবসায় দিয়ে সবার মধ্যে জায়গা করে নিতে। আজকে পনেরদিন ক্লাসের পরীক্ষায়  পরপর দুটি সপ্তাহে আমি ক্লাসে মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছি ,তুমি আমাকে আগের থেকে সব পড়া বুঝিয়ে আমাকে তৈরী করে দিয়েছো তাই কোন অসুবিধা হয়নি উত্তর লিখতে । আমি তোমার জন্য এইকদিনের মধ্যে দিদিমণিদের নজরে পরে গেছি । ওনারা আমাকে উৎসাহ দেন বলেছেন বিনোদিনী তোমাকে এই সর্বোচ্চ নম্বর ধরে রাখতে হবে ফাইনাল পরীক্ষায়ও। তোমার মতো মেধাবী মেয়ে খুব কম হয়। আনন্দ শুনে বলল আমিও তোমার মধ্যে সেই সম্ভাবনা দেখেছি বিনু,দেখবে তুমি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে তোমার মেধার গুণে।

ঘড়িতে দশটা বেজে গেছে ঘন্টার আওয়াজে আমার চেতনা ফিরে এলো , কালকের চিঠিতে আনন্দের আবদার সকলের কুশল বার্তা ছাড়া আমার হাসপাতালের কাজের অভিজ্ঞতা সব লিখে খুব তাড়াতাড়ি চিঠি লিখে পাঠাতে, আনন্দ অপেক্ষায় থাকবে আমার চিঠির । আমি কলম কাগজ নিয়ে বসলাম আমার ভালবাসার মানুষের আবদার রাখতে। আনন্দকে গোপালের কথা,মা বাবার কথা সব লেখার পর লিখলাম।

  জানো আনন্দ তোমার জীবনের প্রাপ্তির খবরে আমি খুব খুশি হয়েছি ,আমাকে এই ছমাস আবার একা থাকতে হবে ভেবে কষ্ট হয়েছিল প্রথমে ঠিকই। কিন্তু চিন্তা করে দেখলাম এইকবছর পরবাসে এককী থেকে তুমি তো এই প্রাপ্তিটুকুর জন্য এতকষ্ট করেছো। অবশেষে তোমার সাফল্যের চাবিকাঠি তোমার হাতের মুঠোয় এসেছে এতে ভীষণ আনন্দিত হয়েছি আমি ।  ভগবানের কাছে আমার নিজের জন্য কিছু চাওয়ার নেই আমার তো তুমিই আছো, আমার চাওয়া পরিবারের সবাই ভালো থাকুক। তোমার মনোঃস্কামনা পূর্ণ হোক,তোমার কষ্ট করা সার্থক হোক । 
  
এবার তোমাকে আমার হাসপাতালের এক অভিজ্ঞতার কথা বলি।জানো আনন্দ বেশ কিছুদিন আগে একটি মেয়ে তাঁর মাকে আমার কাছে নিয়ে আসে,মেয়েটি বিবাহিত বছর কুড়ি বয়েস হবে  । তবে মেয়েদের সংক্রান্ত কোন অসুখ নয় ওরা ভুল করে আমি মেয়ে ডাক্তার বলে আমার কাছে আসে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে?, মেয়েটি বলল ডাক্তার দিদি আমার নয় আমার মায়ের কি অবস্থা দেখুন । বিশ্বাস করো আনন্দ মেয়েটি যখন ওর মায়ের হাতটা ধরে আমাকে দেখালো আমি দেখে হকচকিয়ে যায় ।

 বললাম এইরকম হলো কি করে, মেয়েটি বলল এই বয়সে কি ক্ষমতা হয় বলুন কুড়িজনের ভাতের হাঁড়ির ফ্যান গালার। আমার বৌদি তাঁর বাপের বাড়ির লোকজনকে খাওয়াবে বলে আমার এই শান্তশিষ্ট মায়ের উপর হকুম জারি করে । মা কিছু বলতে পারে না কিন্তু শরীরে তো  দেয়না তাই এই দুর্ঘটনা । আমি বললাম কবে হয়েছে এই দুর্ঘটনা?, মেয়েটি বলল দিন চার আগে। আমার বৌদি এতটাই অমানবিক আচরণ এক ফোঁটা ঔষধ তো দেয়নি উপরন্তু কাজ থেকেও রেহাই দেয়নি। আমি আজকে গেছিলাম বলে দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে জোর করে নিয়ে এসেছি । 
 
আমার মা কিছুতেই আসবেন না কিন্তু আমি ওসব অজুহাত  শোনার মেয়ে নয়, একরকম তাই জোর করে নিয়ে এসেছি। দেখলাম বছর পঞ্চাশের শীর্ণকায় বিধবা মহিলা, দেখেই মনে হচ্ছে ভালো মানুষ ।ওনার কথার ধরণ এতো সুন্দর আমি মুগ্ধ হলাম । আমাকে বললেন না গো মেয়ে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে কাজ করার । মণি সবসময় ভাবে ওর মায়ের খুব কষ্ট তারজন্য কোন কথা শুনলো না, আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে এলো ।কত কাজ পরে আছে আমার বৌমা বাচ্চা নিয়ে পেরে উঠে না। সেসব দেখে মা হয়ে আমি চুপ করে বসে থাকবো বলতো মেয়ে ।
আমি বললাম কিন্তু নিজেকেও ভালো রাখতে হবে, আমার তো মনে হচ্ছে কদিন আপনি রাতে ঘুমাতে পারেনি যন্ত্রণায়।উনি চুপ করে রইলেন, আমি একজন  নার্সকে ডেকে ওনার হাতের ড্রেসিং করতে বললাম । খানিকক্ষণ পরে উনার হাত নার্স  ব্যান্ডেজ করে আমার কাছে নিয়ে এলে বললাম মাসিমা আপনাকে সাতদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে,প্রতিদিন দুবেলা আপনার ইনজেকশন, ঔষধ চলবে নইলে ওই হাত সেপটিক হয়ে গেলে আপনাকে  বাঁচান যাবে না । উনার মেয়ে মণি দিদি আমার মায়ের ভীষণ ছোঁয়াছুঁয়ির বাতিক,হাসপাতালে থাকলে না খেয়েই মরে যাবে । আমি বললাম কেন মাসিমা আপনি তো মা ,আপনার খাবার আপনার সন্তান না ছুঁয়ে অন্য কেউ ছুঁলে আপনি খাবেন না । আপনি একবারও ভেবে দেখেছেন সেও অন্যকোন মায়ের তো সন্তান । যেখানে ভালবাসা থাকে সেসব খাবার আমাদের আঙ্খাকিত হওয়া উচিত  নিজের সন্তানের তুচ্ছতার দানের থেকে। 

সেইসময় ভদ্রমহিলার জামাই মানে মণির বর একজনকে নিয়ে এসে বললেন মা মামাবাবু এসেছেন। ভদ্রলোক বললেন দিদি তুই আমাকে আর তোর ওখানে আসতে বারণ করলি তোর বৌমা পছন্দ করে বলেনা। আজকে মণি ওর বর না পাঠালে তো জানতাম না তুই এই কষ্টে আছিস। ডাক্তার ম্যাডাম আপনি আমার দিদিকে ভালো করে দিন।এবার আমার দিদিকে আমার কাছে রেখে দেবো । অত বড় বাড়িতে আমি একা থাকি,এবার থেকে আমরা দুইভাই বোন মিলে থাকবো ।আমার তো দিদি ছাড়া আর কেউ নেই ।

এরপর কদিন ভদ্রমহিলা হাতের একটু যন্ত্রণা ছিল এবং অবস্থাটা একটু খারাপ হয়ে ছিল তবে আস্তে আস্তে সেরে উঠেছেন, সাতদিনের জায়গায় বারোদিন থাকতে হয়েছিল । ওনার ভাই রোজ দিদির জন্য খাবার এনে দিতেন কিন্তু উনি রাতে হাসপাতালের খাবারটা  খেতেন,  আমি সময় পেলেই ওনাকে বোঝাতাম মনুষ্যত্ব যার নেই তাদের থেকে দূরে থেকে নিজের মূল্যটা বোঝাতে হবে । একটা সময় আপনি নিজের সমস্ত সময় অপচয় করে ছেলেকে, মেয়েকে মানুষ করেছেন এখন আপনার ওদের থেকে ফিরে পাবার পালা। ওদেরও দায়িত্ব আর কর্তব্য পালন করার উচিত আপনার প্রতি, কষ্ট দেওয়া নয়। মা কোনদিন বোঝা নয় মায়ের উপস্থিতি সংসারের আশীর্বাদ সন্তানদের বুঝতে হবে,জানি আপনি নিরুপায় ছিলেন অতিরিক্ত  সন্তান স্নেহে  । কিন্তু আপনার একবার আপনার যন্ত্রণা ক্লিষ্ট রাতে আপনার পাশে বসতে পারত ইচ্ছে করলে তাহলে আপনার মনের যন্ত্রণা তো কমতো। উনি নিরবে চোখের জল মুছতেন বলতেন  সবই আমার ভাগ্য । উনার ছুটির দিন মণি আমাকে প্রনাম করে বলল আপনি আমার মায়ের জীবন দিলেন নতুন করে ,আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো আমি । আমার মাকে বুঝিয়ে অনেকটা পাল্টাতে পেরেছেন নইলে আগে নিয়মের দোয়াই কিছু খেত না।সেইজন্য এতো রোগা ও দূর্বল হয়ে গেছে । তারপর এই বয়েসে হাড়ভাঙা খাটুনি,দেখুন দাদা একবারও মায়ের খোঁজ করল না বৌয়ের ভয়ে। আমি বললাম  ছাড়ো দুঃখ পেয়ো না সংসারে সবাই সমান হয়না । এখন তোমার মামা আছেন আর কোন অসুবিধা হবে না মায়ের । ওরা চলে যাবার পর ভাবলাম একটা মেয়ে আরেকটা মেয়ের কষ্টের কেন কারণ হয় আমাদের এই সংসারে ।ছেলেরা বরং অনেক সহানুভূতিশীল ,মেয়েরা বেশিভাগ  মেয়েলি হিংসার বলি হয় তবুও মেয়েরাই  অন্যায় করে অন্য মেয়ের সাথে ।

** অলোকা চক্রবর্তী **                   **চলবে **



  
 





Comments

Popular posts from this blog

আমার স্বপ্নের ঘর

মল্লিকাঅর্জুন ( চতুর্থ পর্ব)

আমি সেই মেয়েটা