একটি মেয়ের উত্তরণের গল্প
** একটি মেয়ের উত্তরণের গল্প ( তৃতীয় পর্ব)**
আনন্দের বিলেত যাবার খবর পেয়ে আনন্দের মা,বাবা কলকাতায় চলে আসেন । আনন্দের মা তো ছেলেকে অনেক কাকুতি মিনতি করলেন যাতে আনন্দ বিদেশে পড়তে না যায় । ওনার কথা "তোকে কখনও বাধা দিইনি তুই যা চেয়েছিস তাতেই তোর পাশে থেকেছি কিন্তু এবার আমার কথা তোকে শুনতে হবে। তুই এখানে থেকে প্র্যাকটিস কর বিদেশ গিয়ে কাজ নেই" ।আনন্দের বাবা বললেন "বিলেতে পড়ার সুযোগ পাওয়া এতো অনেক ভাগ্যের ব্যপার গিন্নি, ওকে বাধা দিওনা যেতে দাও। চারবছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে চিন্তা করোনা" ।
এইকথা শুনে আনন্দের মা কেঁদে ফেললেন বললেন "তোমরা ছেলেরা শুধু নিজেদের পসারের কথা ভাবো, মায়ের মনের কষ্ট কি করে বুঝবে তোমরা । তবে খোকা তুই গেলে বৌমাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যা"। আনন্দ শুনে বলে "মা ইউনিভার্সিটি আমার শুধু পড়া-- থাকার খরচ দেবে ,আমি তো ওখানে চাকরি করতে যাচ্ছি না। আমার সঙ্গে বিনু গেলে আলাদা বাড়ি ভাড়া করে থাকতে হবে ।এতো খরচ কি করে সামলাবো।তাছাড়া বিনু সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে ওর পড়াশোনা নষ্ট করার কোন মানে হয় ,এতো ভালো পড়াশোনায় যখন বিনু" ।
শ্বাশুড়ীমা বললেন "আমি এখানে একা বৌমাকে থাকতে দেবো না, সোমত্ত মেয়ে একা একা কলকাতা শহরে থাকতে দিতে পারিনা" ।আনন্দ বলল "মা বিনু তো একাই থাকে , গনেশ দাদা,আর কমলার কাছে । আমার ফিরতে কত রাত হয়ে যায়" । তবু উনি বললেন "তুমি যেখানে খুশি যাও ,জানি তুমি আমার কথা শুনবে না । তাই আমার সিদ্ধান্ত আমি বৌমাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরবো" । ঠিক সেই সময় রমেশ ঠাকুরপো এসে বলল "বৌঠান আনন্দ আমাকে তোমার ডাক্তারি ভর্তির ব্যবস্থা করতে বলেছিল,আমি দৌড়াদৌড়ি করে তোমাকে ডাক্তারীতে ভর্তি করে এই আসছি,কাল থেকে তোমার ক্লাস করতে হবে । তোমার হোষ্টেল ও ঠিক হয়ে গেছে" । শ্বাশুড়ীমা বললেন "কই বৌমা তুমি ডাক্তারী পড়বে বলোনি তো একবারও", আমি বললাম "মা আমি এইমাত্র আপনার মতো জানলাম, উনি তো এই নিয়ে কোন কথা আমাকে বলেননি"।
আনন্দ বলল "না বিনু আমি চেয়েছিলাম ভর্তি হওয়ার পর তোমাকে জানাবো" । আমি বললাম "ডাক্তারি পড়া তো খুব কঠিন পড়া আমি কি পারবো?, আনন্দ বলল "তোমার মেধা আছে বিনু , তুমি ভাবছো কেন তুমি ঠিক পারবে, মন দিয়ে পড়াশোনা করো"। আমাদের কথাবার্তা শুনে আনন্দের মা আরও রেগে গেলেন। বললেন "তোমরা যখন নিজেদের মতো চলবে তখন আমরা আর এখানে পরে থেকে কি করবো আমরা বাড়ি চলে যাচ্ছি। আনন্দ মায়ের কাছে গিয়ে বলল "ওইরকম বোলো না মা ,তোমাদের আশীর্বাদ সবসময় আমাদের দরকার"।
যাইহোক আনন্দের মা-বাবা আরো কয়েকদিন থেকে গেলেন ছেলের উপর দুর্বলতা তো আছেই। আমি মেডিকেল কলেজে গিয়ে পরেরদিন ক্লাস করলাম তবে হোস্টেলে গেলাম না কয়েকদিন পর যাবো ঠিক করলাম। আনন্দের বিলেত যাওয়া তারিখ এগিয়ে এসেছে তাই মন চাইছিল না ওকে ছেড়ে চলে যেতে । আনন্দও বুঝতে পেরে আর কিছু বলল না ।
এরমধ্যে আনন্দ একদিন আমাদের সবাইকে কালীঘাটে মায়ের দর্শনের জন্য নিয়ে গেল।আনন্দের মা খুব খুশী হয়েছেন মায়ের দর্শন করতে পেরে।একদিন আনন্দ আমাকে নিয়ে গিয়ে অনেকগুলো শাড়ি কিনে দিয়ে বলল "স্কুলে তো তোমার শাড়ির প্রয়োজন হয়নি, স্কুলের নিজস্ব আলাদা পোশাক ছিল ।এখানে তোমার লাগবে, দেখবে কত সেমিনারে যেতে হবে "। "তুমি তোমার হাতখরচার টাকা থেকে যা প্রয়োজন কিনে নেবে । কারণ তোমাকে একা এখন থাকতে হবে আমি তো থাকবো না । আর সবসময় হোষ্টেলে থাকতে হবে না ,রাত হয়ে গেলে থেকে যেও সেইদিন" ।
এর কয়েকদিন পরে আনন্দ চলে গেল আমাকে ভীষণভাবে একা করে। আমি ঘরে ঢুকে খুব কাঁদছিলাম ওর গাড়িটা চলে যাবার পর । হঠাৎ দেখি আমার মাথায় হাত, তাকিয়ে দেখি আনন্দের মা,আমাকে বললেন "মন খারাপ করো না বৌমা । তুমি খুব ভালো করে পড়াশোনা করে ওর স্বপ্ন সফল করো"। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম আনন্দে মায়ের মুখে এই কথা শুনে ।কয়েকদিন পর উনারাও গ্রামের বাড়িতে চলে গেলেন ।আমি মন খারাপ নিয়ে আবার পড়াশোনায় মন দিলাম ।
আমাদের ক্লাসে ত্রিশটা ছেলে আর বারোটা মেয়ে, তারমধ্যে দুটো মেয়ে খ্রিষ্টান, তাঁরা ইংরেজীতে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে, আমাদের সঙ্গে মেশে না। আমার দুজন খুব ভালো বন্ধু হয়েছে অনিন্দিতা,রত্না । অনিন্দিতা বাঁকুড়ার মেয়ে, রত্না কলকাতার। আমরা তিনজন কোন চ্যাপ্টার বুঝতে না পারলে স্যারেদের সাহায্য নিই। স্যারেরা খুব সাহায্য করেন আমাদের পড়াশোনার উৎসাহ দেখে। এইভাবে চলছিল বেশ আমার পড়াশোনা কিন্তু ইদানিং শরীর ঠিক যাচ্ছে না । ঠিক বুঝতে পারছি না অন্য উপসর্গ দেখা দিচ্ছি মাঝেমধ্যে । আনন্দের একটা চিঠি এসেছে ওর খুব মন খারাপ আমাকে ছেড়ে, আর বলেছে যে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে যেন ও এসে ওর ডাক্তার বৌকে দেখে । আনন্দকে আমার শরীরের কথা জানানো হয়নি চিন্তা করবে বলে , কি হয়েছে আমি নিজেও তো বুঝতে পারছি না । কোন কিছু খেতে ভালো লাগছে না, বন্ধুদের বলে দুদিন কলেজ গেলাম না ।
আমার অবস্থা দেখে গনেশদাদা আমাকে না জানিয়ে রমেশ ঠাকুরপোকে কখন খবর দিয়ে এসেছে।হঠাৎ দেখি রমেশ ঠাকুরপো ডাকাডাকি করছে ,আমি কাছে গিয়ে বলি " কি হলো ঠাকুরপো"? । রমেশ ঠাকুরপো বলল "বৌঠান আমি একজন ডাক্তার, তোমার শরীর খারাপ শুনে আসবো না । আমি বললাম "আপনি শুনলেন কি করে?", রমেশ ঠাকুরপো বলল "আগে এখানে এসো আমি দেখি",আমাকে কি অসুবিধা জানতে চাইলেন বললামও সব। উনি আমার হাতের নাড়ি দেখে বলল "মনে হচ্ছে অন্য খবর",তবু তুমি কালকে রেডি থেকো সকাল নটায় আমি অন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো"। পরেরদিন আমাকে মেয়েদের ডাক্তার একজন লেডি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন । ডাক্তার সব দেখে বললেন আমি সন্তান সম্ভবা,ডাক্তার ওষুধ দিলেন। খাবার খেতে বললেন ভালো করে। ডাক্তার রমেশ ঠাকুরপোকে আমার স্বামী ভেবে স্বামীর কর্তব্য এই সময়ে কি সব বোঝালেন ।
তারপর বাড়িতে এসে চলল নানারকম সাবধান বাণী,
গনেশদাদা শুনে ব্যস্ত হয়ে পরেছেন "বৌদিমণি তোমার যা খেতে ইচ্ছা হয় তুমি আমাকে বলবে ।তুমি সাবাধানে থেকো বৌদিমণি, এইসময় খুব সাবধানে থাকতে হয়"। রমেশ ঠাকুরপো আমাকে ঔষধ সব বুঝিয়ে দিয়ে আবার কমলাকে বলে গেলেন নজর রাখতে যেন আমি ঠিক মতো ঔষধ ও খাবার খাই । আর বলে গেলেন "কলেজে গেলে গাড়িতে করে যেতে উনি গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন "। আমি হেসে বললাম "দরকার পড়বে না আমার মেডিকেল কলেজ কতটুকু বা রাস্তা আমি হেঁটে চলে যাবো, ঠাকুরপো বললেন বৌঠান রাস্তার যা অবস্থা একটু অন্যমনস্ক হলেই পরে যাবে ,আমি তোমাকে এই বিপদে পরতে দিতে পারিনা জেনে শুনে ।
তিন মাস হয়ে গেল আজকাল আমার একটা অন্য অনুভূতি হচ্ছে হয়তো এইসময় আনন্দ কাছে থাকলে আরও ভালো উপলব্ধি করতে পারতাম দুজনে মিলে । গত চিঠিতে আনন্দকে সব কিছু জানিয়েছি, আমি খালি ভাবছি আনন্দ কতটা খুশি হয়েছে বাবা হওয়ার খবরে শুনে।
** অলোকা চক্রবর্তী ** **চলবে **
Comments
Post a Comment