( দাদার জিজ্ঞাসা-- ২য় পর্ব) বোনের অনুশোচনা
** বোনের অনুশোচনা**
** অলোকা চক্রবর্তী**
দাদা !! আজ রাখি পূর্ণিমা অথচ আমার এমনি দূর্ভাগ্য তোকে রাখি পরাতে পারলাম না । সকালবেলা উঠে স্নান করে তোর নামে পূজো দিয়ে সারাদিন অপেক্ষা করেছি বিশ্বাস কর দাদা , আমি বুঝতে পারিনি আজকের দিনটাও ষড়যন্ত্রকারীর স্বীকার হবো আমি।আমার এই লেখা তোর কাছে পৌঁছাবে কিনা জানিনা তবুও তোকে কতগুলো কথা বলার জন্য লিখলাম। আমি এখনও জলও খাইনি দাদা , শুধু চোখের জল বাঁধ মানছে না এটা জেনে তুই এই বাড়ির গেটের সামনে অতক্ষণ অপেক্ষা করে চলে গেছিস । এই শাশ্তি কি পাওয়ার কথা দাদা তোর , আমার । অন্যায় হয়েছিল আমার একটা মেরুদন্ড হীন মুখোশ ধারী ছেলেকে আমি চিনতে পারনি। অর্ক্য যদি সত্যি ভালবাসত আমাকে তাহলে জোর খাটিয়ে ছমাস পর ফিরে এসে আমাকে নিয়ে যেত পারতো। এই যক্ষপুরীতে ওর মা কি করতে পারে এ অভিজ্ঞতা ওর নিশ্চয় আছে। আমি একটা মেয়ে কি করে সামলাবো ভাবলো না এমন ভালবাসা ওর।
আজকে গেটের দারোয়ান কিছুক্ষণ আগে চা নিতে এসে বলল বৌদি আজকে মনে হয় আপনার দাদা এসেছিলেন ।আমি বললাম সেকি আপনি আমাকে বলেননি কেন?, কেন দাদাকে বাড়ির ভিতরে আনলেন না?। তখন ওনি বললেন কি করবো বৌদি বড় ম্যাডামের কড়া অর্ডার ছিল যেন কাউকে গেটের ভিতর ঢুকতে না দিই। সেইজন্য আমার সঙ্গে আরেকজন লোককে ওনি সারাদিন রেখেছিলেন পাহাড়ায় এবং এই খবর আপনার কাছে দেওয়াও বারণ ছিল । গরীব মানুষ চাকরি গেলে কি খাবো বলুন তবুও আমি এক থাকলে কোনভাবে ম্যানেজ করতাম কিন্তু আজকে সেই সুযোগ ছিলনা । আমি সবটুকু বুঝতে পেরে ওনাকে কিছু না বলে আমার ঘরে চলে আসি ।
জানিস দাদা ! আমার এই বিয়েটা করাই জীবনে একটা বিরাট ভুল হয়ে গেছে । আসলে এতদিন অর্ক্যর সঙ্গে মিশেছি কিন্তু কোনদিন ওর পয়সার অহংকার ছিল না, একদম একটা সাদাসিধে ছেলে ভেবেছিলাম । তাই ভাবতেই পারিনি ওরই মা টাকার অহংকারে মানুষ হয়ে মানুষকে এতটা তুচ্ছ ভাবতে পারে। এই বাড়ির সমস্ত কিছু অর্ক্যর মায়ের আঙুলের নির্দেশে চলে। জানিস দাদা ! একটা কথা আছে না মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু তাঁর জলন্ত উদাহরণ আমার শ্বাশুড়ীমা ।
বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে' ওনি, বাবার সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হয়ে ওনি মানুষকে মানুষ ভাবেন না । সারাদিন বাড়িতে থাকেন না ক্লাব,পার্টি, বন্ধু বান্ধব নিয়ে কাটিয়ে মাঝরাতে বাড়িতে ফেরেন। কথার কি ভীষণ ঝাঁজ যা সহ্য করা যায় না ।
জানিস দাদা ! বিয়ের পরেরদিন এখানে এসে শুনলাম ওদের বাড়িতে বৌভাতের অনুষ্ঠান হয়না। আসলে তখন বুঝিনি আমার বাপের বাড়ির লোকেদের ওনি ওনার লোকেদের সামনে আনতে চাননা গরিব বলে। বিয়ের বাড়িতে কোন আত্মীয় স্বজন নেই ।বৌভাতের দিন বিকেলে ওর কাকা ,কাকিমা কিছুক্ষণের জন এসে আমাকে উপহার দিয়ে চলে যান। রাতে বাড়ির বাগানে অর্ক্যর অফিসের কয়েকজন,আর মায়ের বন্ধু বান্ধবদের পার্টি যেখানে আমাকে একবার অর্ক্য নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে আবার ঘরে দিয়ে যায় ।
সবচেয়ে বড় চক্রান্ত কি জানিস দাদা ! আমাদের ফুল সজ্জার রাতে সারারাত ওনি অসুস্থতার অভিনয় করে ডাক্তার , ঔষুধ অক্সিজেন এইসবে অর্ক্যকে ব্যস্ত রেখে আমার থেকে দূরে রেখেছেন । তারপরের দিন হঠাৎ শুনি অর্ক্যের কোন আত্মীয় অর্ক্যর জন্য বিশাল চাকরির সুযোগ করে দিয়েছেন তাই ওনি টিকিট হাতে ধরিয়ে যত রকমের অশান্তি করা যায় করে অর্ক্যকে পাঠিয়ে দিলেন বিদেশে ।
আমার মনের সেদিন কি ভয়ানক অবস্থা হয়েছিল তুই ভাবতেও পারবিনা দাদা ,অর্ক্যর যাবার আগে আমরা একটু সময় পেলাম না নিজেদের মনের কথা গুলো বলার ওনি এতটাই সাংঘাতিক । অর্ক্য চলে গেল আমাকে ফেলে ,এইরকম পরিস্থিতে পরে আমার নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। আমার কাছে তুই নেই , আমার কাছে সেও নেই যাকে বিশ্বাস করে তোদের ছেড়ে চলে এসেছিলাম । সেই অন্তরজ্বালায় জ্বলে পুড়ে মরে যাচ্ছিলাম এ আমি কি করলাম তাই নিজেকে ঘরে মধ্যে বন্দী করেছিলাম। তখন আমার শ্বাশুড়ীমা আমার ঘরে এসে আমাকে বলেন তোমাদের মত মেয়েরা তো শাড়ি,গয়নার লোভে বড়লোকের ছেলেদের ফাঁদে ফেলে । এবার শাড়ি,গয়নায় যত পারো নিজেকে সাজাও,এত কান্নাকাটির কি আছে। আসলে ওনি তো সারাদিন বাড়িতে থাকেন না তাই বাড়ির দেখাশোনার জন্য একটা লোকের দরকার ছিল ওনার ,সেই চালাকি ওনি আমার এবং অর্ক্যর সাথে করেছেন।
দাদা আমি ওনার অনুপস্থিতিতে পালিয়ে বাড়িতে ফিরে যেতে পারতাম কিন্তু অসহায় মায়ের কথা ভেবে পারিনি। মায়ের কত আশা তার মেয়ের কত ভালো বিয়ে হচ্ছে , বারবার মা বলছিলেন ,,"দেখবি তুই খুব সুখী হবি। আমার চোখ ভালো হয়ে গেলে আমি খোকার সঙ্গে গিয়ে তোর শ্বশুরবাড়ি দেখে আসবো"। বিয়ের দিন গায়ে হলুদের পর যখন দাদা ! তুই গয়না গুলো দিয়ে বললি পরে নিস সবগুলো সাজার সময়। বিশ্বাস কর দাদা তখনই আমি বুঝে গেছি তুই আমার জন্য ধারে জর্জরিত হয়ে গেছিস, কারণ এতো গয়না কেনার সামর্থ্য কোথায় আমাদের । মনে মনে ভেবছিলাম বিয়ের ঝামেলা মিটে গেলে চাকরির চেষ্টা করবো অর্ক্যকে বলে যাতে তোর ধার শোধ করতে তোর পাশে থাকতে পারি। ভাবতে পারিনি অত্যন্ত কুরুচি সম্পূর্ণ মানসিকতা একটা মহিলার চক্রান্তের শিকার হবো আমি,তুই আর আমার পরিবার। এই একবছর অর্ক্যের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই হয়তো অর্ক্যের চিঠি ওনি আমার কাছে পৌঁছাতে দেননা। একবছর শুধু মুক্তির পথ আমি খুঁজে চলেছি এই যন্ত্রণা থেকে অবশেষে একটা আলো সন্ধান পেয়েছি।
দাদা আমার কোচবিহারের একটি মেয়েদের স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি প্রায় ঠিক গেছে। এই বাড়িতে সবকিছু দেখাশোনা করে মিনাদি ,ওর বাড়ি কোচবিহারে। কিছু দিন আগে ও বাড়িতে যাবে তখন লুকিয়ে আমার এক বান্ধবীর ঠিকানা দিয়ে ওর হাত দিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলাম সবকথা লিখে। কদিন আগে মিনাদি ফিরে এসেছেন। আমার বান্ধবী রমলা উত্তর পাঠিয়েছে --ও লিখেছে ওর জ্যাঠু ওখানকার স্কুলের সেক্রেটারি, ওনাকে রমলা আমার কথা সব জানালে ওনি বলেছেন একজন ইংরেজি শিক্ষিকার খুব প্রয়োজন যত তাড়াতাড়ি পারি ওখানে চলে যেতে।
দাদা আমি যেকোন দিন সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে যাবো এই জেলখানা থেকে। তবে এখান থেকে বেরিয়ে একবার মায়ের সঙ্গে ও তোর সঙ্গে দেখা করবো। তারপর তোকে সঙ্গে নিয়ে আমার জীবনের নতুন সুচনা পথে এগোব। জীবনের ভুলগুলো শুধরবার সুযোগ পাবোনা তবু মাঝে মাঝে তোকে তো দেখতে পাবো। তোর হাতটা আমার মাথায় ছোঁয়াস তাহলেই আমি জানবো আমার ভগবানের আশির্বাদ আমাকে সব কঠিন লড়াইয়ে জিতিয়ে দেবে ঠিক। আমার দাদা আমার পাশে থাকলে এই পৃথিবীর কোন দুঃখ আমাকে ছুঁতে পারবে না এই আমার বিশ্বাস।
Comments
Post a Comment