একটি মেয়ের উত্তরণের গল্প (১১তম পর্ব)
**একটি মেয়ের উত্তরণের গল্প ( ১১ তম পর্ব)**
আনন্দ চলে এসেছে সবকাজ সেরে, হয়তো কিছুদিন পর কয়েকদিনের জন্য ওকে একবার দিল্লি যেতে হবে। আনন্দ আসাতে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি। আনন্দ ছাড়া আমি একদম মনোবল পাইনা। বিয়ের পর পরই আমাদের দুজনকে পরস্পরকে ছেড়ে থাকতে হয়েছে অনেক বছর । শুধু মাঝে গোপালের অন্নপ্রাশনের সময় কিছুদিনের জন্য এসেছিল।অনেক বছর দুজনে অনেক জীবন যুদ্ধের পর এবার আমরা একসঙ্গে পথ চলবো ,হয়তো অভিমান হবে আমাদের চলার পথে কিন্তু অভিযোগ বা অনুযোগ থাকবে না আমাদের দুজনের । আমাদের ভালবাসার গভীরতা এতটাই বেশি যে আমরা পরস্পরের দোষ ত্রুটি নিয়ে অত আলোড়ন না তুলে চেষ্টা করবো দুজনের সমঝোতায় সেই ভুল ত্রুটি শোধরানোর ।
আমার জীবনের দেবতা আনন্দ, হয়তো আমি নিজের অজান্তে ভগবানের থেকে ওর উপর বেশি ভরসা রাখি। আমি আজকে যেখানে অবস্থান করছি সেটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল, আমি ভাবিনি কোনদিন আমি নিজের জীবনের উত্তরণ ঘটিয়ে আরও পাঁচটা মেয়েকে সাহায্য করতে পারবো। আমার ভাগ্যলিপি যেমন আনন্দ ও তাঁর পরিবারের সাহায্যে পাল্টে গেছে তেমনি আমি ও চেষ্টা করি আনন্দ চাওয়াকে সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে সমাজের কিছু মানুষকে সাহায্য করতে। আজও সমাজে মেয়েদের দূর্দশার শেষ নেই,কেউ নিজের পরিবারের সদস্যদের বিশ্বাসঘাতকতায় ,কেউ শ্বশুরবাড়ির মানুষদের অসহযোগিতার কারণে। আর ভালবাসার ছলনায় কত মেয়ের যে জীবন শেষ হয়ে গেছে বলার নয়। এই একই সমাজের মানুষ তো আনন্দ এবং রমেশ ঠাকুরপো, এদের মানসিকতা কত উদার ,কত মানবিক।
যাহোক একদিন আমরা সবাই মিলে মানে রমেশ ঠাকুরপো,বড়মামা,মামীমা, আমাদের মা এবং আমরা দুজনে মায়াতে বাড়িতে পৌঁছাতে মায়ার মা আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন।একটু পরেই মায়া চা, মিষ্টি নিয়ে এলো। মায়া আজকে হালকা একটা আকাশি রঙের শাড়ি পড়েছে বেশ সুন্দর লাগছে। মায়া মোটামুটি সুন্দরী, ওকে এক দেখায় যেকোনো ছেলেরই পছন্দ হবে কিন্তু যেটা আশ্চর্য আমি হলাম আমি জানতাম না মায়ার এত সুন্দর গানের গলা, মায়াকে মামীমা জিজ্ঞেস করেছিলেন "তুমি কি গান জানো তাহলে একটা শোনাও "না। মায়া হেসে মাথা নেড়ে কি দরদ দিয়ে গাইলো
"আমার মল্লিকা বনে যখন প্রথম ধরেছে কলি
তোমার লাগিয়া তখনি বন্ধু, বেঁধেছিনু অঞ্জলী
তখন কুহিলিজালে সখা, তরুণী উষার ভালে শিশিরে শিশিরে অরুণমালিকা উঠিতেছে ছলছলি--"
আমরা নির্বাক হয়ে শুনলাম মুগ্ধ হয়ে, মামিমা খুব খুশি হয়ে মায়াকে আশীর্বাদ করে বললেন "তুমি আমার রমেশের যোগ্য সহ ধর্মিনী হবে", তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে রমেশ ঠাকুরপো বললেন "আমার একটা কথা আছে। আমার একটাই শর্ত পড়াশোনাটা আমার বৌঠানের মত চালিয়ে যেতে হবে"। মায়ার মা বললেন "এটাতো আমার মেয়ের পরম সৌভাগ্য হবে, আমার মেয়ে ভীষণ পড়াশোনা করতে চায় কিন্তু সুযোগ হয়নি ওর বাবা হঠাৎ চলে যাওয়ায়" ।
আমি বললাম "মায়া তোমার সব ইচ্ছে তুমি আমার রমেশ ঠাকুর কে বলো তোমার কোন ইচ্ছা অপূর্ণ থাকবে না"। মামীমা বললেন "আমাদের বিনু কতটুকু মেয়ে ছিল সে তো এই কলকাতা শহরের পরিবেশ মানিয়ে আজ এত লেখাপড়া শিখে একজন সফল ডাক্তার তাহলে মায়া তুমি কেন পারবে না", "নিশ্চয়ই আমার ছেলে তোমাকে সাহায্য করবো। তুমি লেখাপড়া চালিয়ে যেও আমাদের কোন আপত্তি নেই"। মামিমার কথা শুনে আমার খুব ভালো লাগলো প্রত্যেকটা মেয়ের জন্য যদি এরকম ভাবনা হতো শ্বশুর বাড়ির লোকেদের তাহলে হয়তো আজকে সমাজে মেয়েরা অনেক এগিয়ে যেত ।অধিকাংশ মেয়েরই যে ভীষন গঞ্জনাময় জীবন অন্তত কিছুটা তার পরিবর্তন হতো।
এরপর দুই একটা কথার পর মায়ার মা সংকুচিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন "মনে যদি কিছু না করেন একটা কথা জানতে পারি আপনারা কজন বরযাত্রী আসবেন ?"।সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ বলল "ওই নিয়ে আপনি একদম ভাববেন না , আমরা বাড়ির দশ বারোজন আর রমেশের কয়েকজন বন্ধু , সম্ভবত কুড়ি জনের বেশি হবে না"। মায়ার মা বললেন "সেকি এত কম কেন,বাড়ির সবাইকে নিয়ে আসুন আমার সামান্য আয়োজন হয়তো কিন্তু আন্তরিকতার অভাব হবে না"। আনন্দ বলল "আগে একবার তো আপনি দেড়শো জন বড়যাত্রীর ব্যবস্থা করেছিলেন সেই সব তো নষ্ট হয়েছে জানি আবার আপনাকে আমরা বিব্রত করতে চাই না", মায়ার মা বললেন "এই একটা দিনই তো আমি সুযোগ পাব আপনাদের পরিবারের লোকের সেবা করার সেই সুযোগটা আমায় দেবেন না"। আমি বললাম "সেসব পরে হবে এখন তো আমরা নিজেদের লোক হয়ে গেলাম আসা যাওয়া তো লেগে থাকবে আপনি সব জোগাড় করুন আমরা ঠিক সময় পৌঁছে যাব"। মায়াকে বললাম "ভালো থেকো আর খুব সুন্দর করে সাজবে যেন আমার ঠাকুরপো চোখ ফেরাতে না পারে"।
আমাদের বাড়ি থেকেই রমেশ ঠাকুরপোর বিয়ে হচ্ছে, গ্রামের বাড়িতে হলে মায়ার মায়ের অসুবিধা হবে সেজন্য । গ্রামে পরে একটা অনুষ্ঠান করার মামার ইচ্ছে । বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজন এসেছেন,আমি কয়েকদিন ছুটি নিয়েছি। সবকিছু গনেশ দাদা সামলাচ্ছেন, রান্না ঠাকুর জোগাড় করা, জিনিসপত্র আনা ,সবার খাবারের ব্যবস্থা করা। আমাদের গ্রামের বাড়িতে থেকে কয়েকজন এসেছেন তাঁরা বাড়ির ভিতরের কাজ সামলাচ্ছেন বাইরের সবকিছুই গনেশদাদা । যে রমেশ ঠাকুরপোকে সবাই বাউন্ডুলে বলতো আজকে সে চুপ করে বিয়ের আগের সব নিয়ম কানুন মানছে। আমার গোপালের খুব আনন্দ ওর পিসিদের সব ছেলেমেয়ে এসেছে অনেক খেলার সাথী, গল্প করার মানুষ পেয়ে ।
আমরা সবাই মিলে বড়যাত্রী গেলাম কয়েকটি গাড়িতে মায়াদের বাড়িতে । তারপর আশীর্বাদ সারা হলে বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হলো। মায়াকে আজকে খুব সুন্দর লাগছিল । বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হবার পর আমরা ওদের ওখান থেকে খাওয়া দাওয়া করে রওয়ানা দেবো কিন্তু রমেশ ঠাকুরপো এবং মায়া আমাদের দুজনকে অনুরোধ করে বাসর ঘরে থাকার জন্য । আমি একটু কিন্তু করছিলাম গোপালের জন্য, আমার গোপাল তো রাতে আমাকে ছাড়া থাকে না । আনন্দ আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল "তুমি গোপালের জন্য ভেবো না আমি বড়দি কে বলে দিচ্ছি ।বড়দি ঠিক সামলে নেবে গোপালকে" । আমরা বাসরঘরে রমেশ ঠাকুরপোর কয়েকজন বন্ধু আর মায়ার মাসতুতো বোন আর মায়ার কয়েকজন বন্ধু । হাসি গল্প ঠাট্টায় বেশ রাত কাটছিল ,কেউ কেউ গান করলো । এরমধ্যে মায়ার একবন্ধু বেশ কয়েকটি গান করলো। মেয়েটির নাম রেবা ,দেখতে ভালোই কিন্তু গানের গলা অসাধারণ, ওর গানের সুরে সবাই নির্বাক হয়ে গেলাম । রমেশ ঠাকুরপো এক বন্ধুর ওকে খুব পছন্দ হয়, স্বভাবত ও কৌতূহলী হয়ে মেয়েটির সমন্ধে মায়ার কাছে জানতে চায়। মায়া তখন আমাকে বলল "চুপিচুপি মেয়েটার নাকি ওর কাকিমার বোনের ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছিল। মেয়েটি বিয়ের পর জানতে পারে ছেলেটার জন্মগত হার্টের সমস্যা, ওদের অগাধ পয়সা অনেক চিকিৎসা করেছে কিন্তু ডাক্তার জবাব দিয়েছেন কিছু করার নেই । রেবার শ্বশুর, শ্বাশুড়ীমা জানতেন ছেলে বেশিদিন বাঁচবে না তবু ছেলের মনোস্কামনা পূর্ণ করতে সবকিছু লুকিয়ে একপ্রকার জোর করে বিয়ে দেয় । রেবার কাকিমা সব জানতেন তবুও লুকিয়ে গেছেন ওর মায়ের কাছে ,অসুস্থ ছেলে বিয়ের ধকল নিতে পারেনি বাসর রাতে অসুস্থ হয়, পরেরদিন মারা যায় । এরপর রেবা ফিরে আসে বিধবা তকমা নিয়ে ।
সমাজ ওকে অনেক নিয়মের বেড়াজালে বন্দী করেছিল কিন্তু ওর দাদা মায়ার পাশে দাঁড়িয়ে এইসব মিথ্যা বিয়ের অজুহাত দেখিয়ে বোনের উপর কোন নিয়ম চাপাতে দেবেনা বলেন। দাদা বলেন বিয়েটাই জীবনের শেষ কথা নাকি বাঁচার মত বাঁচতে হবে। রেবা মানসিক ভাবে খুব ভেঙ্গে পরেছিল ওর নিজের কাকিমার বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়ার জন্য।"
"রেবাকে ওর দাদা আবার পড়াশোনার করার ব্যবস্থা করে দেন । রেবা উচ্চমাধ্যমিক পাস করে এখন কলেজে পড়ে"। রেবার এই ঘটনা শুনে আমি অনেকক্ষণ চুপচাপ বসেছিলাম । পরে আমি আনন্দকে দিয়ে রমেশ ঠাকুরপোর বন্ধুকে বাইরে ডেকে এনে সবটুকু বলি। রমেশ ঠাকুরপো বন্ধু সোমনাথ এই ঘটনা শুনে হতবাক হয়ে যায়, খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে বলে "বৌঠান আমরা ফিরে গিয়ে এইনিয়ে আলোচনা করবো । এখন এইরকম অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা হলে হয়তো ওর কানে গেলে ও মানসিক আঘাত পাবে তার থেকে ফিরে আলোচনা করবো কি সমাধান করা যায়" । আমি বললাম "একদম ঠিক বলেছ ভাই ,ওকে বুঝতে দেওয়া চলবে না আমরা সবটুকু জানি"। যাক সকালবেলা এক প্রস্থ কান্নাকাটির পালা শেষ করে আমরা সবাইকে বৌভাতে আসার জন্য বলে নতুন বৌকে নিয়ে বাড়িতে ফিরলাম ।
**চলবে**
Comments
Post a Comment