একটি মেয়ের উত্তরণের গল্প (১০ ম পর্ব)

**একটি মেয়ের উত্তরণের গল্প ( ১০ম পর্ব) **


আনন্দের গত সপ্তাহে দুটো চিঠি এসেছে, একটা মাকে লিখেছে ,আরেকটা আমাকে । আনন্দ লিখেছে "বিনু তোমার চিঠিতে তোমার অভিজ্ঞতা পড়তে পড়তে ভাবি আমাদের সংসারে  কত মেয়ে আছে যারা তোমার মত মেধা বিকাশের সুযোগ পাইনি। আজকে তুমি পেয়েছিলে বলেই তো মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে পারছো। তুমি মা দুর্গার মত সংসার সামলে ,ছেলেকে সামলে সাধারণ মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের যন্ত্রণা লাঘব করার চেষ্টা করছো। এইখানেই আমি সার্থক "।

"আমি তোমাকে সাহায্য করেছি আর তুমি রোজ কত মেয়েকে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে তাদের নতুন দিশা দেখাচ্ছো।  মেয়েদের শিক্ষার এইজন্যই ভীষণ প্রয়োজন কারণ সমাজে মেয়েরা আজও ভীষণ অবহেলিত, অনেকে ভাবে মেয়ে হয়ে জন্মেছে তাঁর আবার কি ইচ্ছা, অনিচ্ছা থাকবে।সংসারের সবার জন্য করায় তার ধর্ম । তাঁদের বোধ হয় না সংসার ধর্ম পালন করতে গিয়ে মেয়েটা হাসতে ভুলে গেছে, তাঁর অসহায় করুণ চোখ দুটোই শুধুই অশ্রু, নেই কোন দাবী  নিজের মতো করে বাঁচতে চাওয়ার তবে তাঁকে ভালো রাখার কেন  আমাদের প্রধান দায়িত্বের  মধ্যে পরেনা"।

আমি আনন্দের চিঠি পড়ে ভাবি মানুষের মধ্যেই দেবতার বাস এই সত্যটা আমি মর্মেমর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছি  । আনন্দ আমার কাছে সাক্ষাত দেবতা ,আমি গ্রামের সাধারণ একটি মেয়ে গ্রামের স্কুলে পাঠ শেষ হতে যখন পড়াশোনা পাঠ চুকে গেল তখন কোন অনুশোচনা হয়নি বরং পড়াশোনার হাঙ্গামা থেকে বেঁচে ছিলাম বলে খুব আনন্দ হয়েছিল  । কারণ আমার চেনা জগতটা খুব ছোট ছিল সেখানে মেয়েদের লেখাপড়া শেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করার মত মানুষ ছিল না যাকে অনুকরণ করে আমি শিখবো সমাজে মেয়েরাও পারে তাদের বুদ্ধি আর মেধা দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে  ।

 তাই  বিয়ে হবে শ্বশুর বাড়ি যাবো সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেবো এইরকম মানসিকতা তৈরী হয়েছিল । সেইজন্য আনন্দের সান্নিধ্যে এসে যখন জানলাম "সংসার ধর্ম পালন করেও মেয়েদের লেখাপড়া শিখে সমাজকে অনেককিছু দেবার আছে" তখন অবাক হয়েছিলাম।  আনন্দের  কথা অবাক হয়ে শুনতাম, আনন্দ  বলেছিলে "লেখাপড়া না শিখলে তো সমাজের অবক্ষয়ের চিত্র বোঝার ক্ষমতা হবে না কোনদিন  । গন্ডি হয়ে যায় সীমাবদ্ধ বেশিভাগ মেয়েদের তাই মানিয়ে নেবার সহজাত প্রবৃত্তির জন্য তাঁরা ওই সুখেই জীবন অতিবাহিত করে কোন আক্ষেপ করে না কি পেলাম আর কি পেলাম না" । ওর কাছে মহীয়সী নারীদের গল্প শুনে কল্পনার জাল বুনতাম,ভাবতাম আমার দ্বারা কি কখনও সম্ভব হবে। তারপর  কলকাতায় নিয়ে এসে যখন আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দিলে আনন্দ আমি তখন সত্যি মনে মনে সংকল্প করেছিলাম আমি মন দিয়ে পড়াশোনা করবো, আমার পাশে তো আমার দেবতা আছে ।

এরপর যতদিন গেছে আমি লেখাপড়ার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছি । যত পড়ার বইয়ের বাইরে বই পড়ছি তত সমাজের এক ভয়ংকর চিত্র জেনেছি । কখনও নিয়মে দোয়াই দেখিয়ে জ্যান্ত মেয়েদের জ্বালিয়ে দেওয়া হতো সম্পত্তির উত্তরাধিকার রাখবে না বলে,আবার কখনো বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে নামক নিয়ম বেঁধে সে কিছু বোঝার আগেই অল্প কিছুদিন পর তাকে বৈধব্যের নিয়মে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে অমানুষিক নিপীড়ন চালানো হতো। সমাজের অনুশাসন মেনে চললে ভালো নইলে সেই মেয়ের কপালে জুটতো নানা অশ্লীল আখ্যান । 

এইসব গল্প  আমাকে খুব কষ্ট দিত তখনই আমি মনে মনে ঠিক করে ছিলাম লেখাপড়া শিখবো আমার নিজের জন্য শুধু  নয় ,আমি আত্মনির্ভর হয়ে আরও  মেয়েদের  পাশে দাঁড়াবো। আমার পাশে যেমন আনন্দ ছিল তেমনি আমিও অসহায় মেয়েদের পাশে থাকবো আমার যতটুকু ক্ষমতা তাঁর সবটুকু দিয়ে । আমি কিছুতেই হেরে যেতে দেবো না কোন মেয়েকে মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে, বরং বোঝাবো সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য পুরুষ ও নারীর উভয়ের যেমন দরকার তেমন শিক্ষার কতটা গুরুত্ব ।

মেয়েরা তো ভবিষ্যত প্রজন্মের বাইক তাই অজ্ঞতা নয় বরং নিজের শিক্ষার আলো ভবিষ্যত প্রজন্মের চলার পথকে অন্ধকার মুক্ত করুক প্রত্যেকটা মেয়ে ।শিক্ষার আলো একমাত্র পারবে ঘোচাতে সংস্কার এবং কুসংস্কার প্রভেদ মানুষকে বোঝাতে । আজকে আনন্দ  তোমাকে একটি অসহায় মা আর মেয়ের গল্প বলি। যাদের জীবনের সঙ্গে আমি জড়িয়ে গেছি অবশ্য এতে শ্বাশুড়ীমা আমাকে খুব সাহায্য করেছেন । তাঁর সহযোগিতার জন্য আমি মনের জোর পেয়েছিলাম।

"মেয়েটির নাম মায়া, সে বাবা,মায়ের একমাত্র সন্তান । মায়ার বাবা স্কুলে শিক্ষকতা করতো ,সেইজন্য উনি মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে বাড়িতে লেখাপড়া শিখিয়েছেন । মায়া স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দেবার পর ওর বাবা হঠাৎ  মারা যান ।  মায়ার মা মেয়েকে নিয়ে অথৈ জলে পরেন ,ওর বাবার অনুপস্থিতির সুযোগে নানা মানুষ নানা কথা শোনাতে শুরু করে এতো বড় মেয়ে এখনও বিয়ে দেওয়া হয়নি বলে"।

 "ওর মা মানুষের কথায়  বিভ্রান্ত হয়ে পরে  তাই মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য আত্মীয় স্বজনের কাছে মিনতি করে একটা সুপাত্রের জন্য । যাহোক একটি ছেলে সরকারি চাকরি করে তাদের পরিবারের সবাই মায়াকে দেখে পছন্দ করে, বিয়ে দিন ঠিক হওয়ার পর দেখা যায় তাদের যৌতুকের তালিকা বিশাল।যা মায়ার মায়ের পক্ষে অসম্ভব দেওয়া । কোন কিছুর সুরাহা না করতে পেরে মায়ার মা দেশের বাড়িতে মায়ার বাবার নামে কিছু জমি ছিল সেটা বিক্রি করার জন্য দেশে যায় মেয়েকে নিয়ে । মায়ার ঠাকুমা সব শুনে বলেন "বৌমা তুমি বিয়ের ব্যবস্থা করো মায়ার কাকা ঠিক সময়ে টাকা নিয়ে পৌঁচ্ছে যাবে,বাড়ির মেয়ের বিয়ের কোন অসুবিধা হবে না" ।

মায়ার মা বিয়ের জোগাড় করেন সাধ্যমত, বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজন সন্ধ্যা লগ্নে বিয়ে ।  সন্ধ্যায় বর যাত্রীরা চলে এসেছে, মায়ার বন্ধুরা মায়াকে সুন্দর করে সাজিয়ে ছাতনাতলায় নিয়ে আসে ঠিক মালা বদলের মূহূর্তে ছেলের বাবা বলেন "বর পণের টাকা না পেলে বিয়ে হবে না"। মায়ার মা মায়ার কাকার ভরসায় বসে থেকে নিরাশ হয়ে শ্বাশুড়ীমাকে বলেন "এবার কি হবে?" । মায়ার ঠাকুমা বললেন "এতক্ষণ ওর কাকার চলে আসার কথা যেটুকু টাকা কম পরেছিল জমি বিক্রি করে বাদবাকি  টাকা তো ঠাকুমা নিজের জমানো থেকে ওর কাকার হাতে দিয়েছেন বরের বাবাকে দেবার জন্য" ।

 সময় চলে যায় "মায়ার মা,ওর আত্মীয় স্বজনেরা বলেন বিয়েটা হোক তারপর আমরা টাকা জোগাড় করে দিচ্ছি" কিন্তু বরের বাবা কোন কথা না শুনে ছেলেকে নিয়ে ফেরত চলে যান। বিয়ে বাড়ির সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়, চুপচাপ হয়ে যায় বিয়ে বাড়ি। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মায়ার মা মেয়েকে দেখতে না পেয়ে মেয়ের নাম ধরে ডাকতে শুরু করে  ঘরের দিকে ছোটেন কিন্তু ওর মা গিয়ে দেখেন ঘরের দরজা বন্ধ আর মায়ার কোন সারা নেই । অনেক ডাকাডাকি পর  সবাই মিলে দরজা ভেঙ্গে দেখে মায়া গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে। 

যাহোক মায়াকে যখন হাসপাতালে আনা হয় তখন ওকে পরীক্ষা করে দেখে মনে হয় শ্বাসযন্ত্রে চাপ লাগায় ও অজ্ঞান হয়ে গেছে তবে ভয়ের কিছু নেই । মায়ার মায়ের তৎপরতায় ওনার মেয়ে এ যাত্রায় বেঁচে গেছে। মায়াকে প্রয়োজনীয় ওষুধ পত্র দিয়ে আমি অপেক্ষা করি ওর জ্ঞান আসার জন্য । আমার এইসমস্ত ঘটনায় মায়ার মায়ের কাছ থেকে শোনা। মায়া সঙ্গে আরও যারা এসেছিল সবাইকে ফিরে যেতে বলি কিন্তু ওর মা মেয়েকে ছেড়ে যেতে চাইলেন না মেয়ের হাত ধরে বসে রইলেন । মায়া ভালো আছে দেখে  আমি বাড়ি চলে আসি তবে ওকে দুদিন হাসপাতালে থাকার ব্যবস্থা করে আসি। "আমার মনে হয়েছে এখনই বিয়ে বাড়ির পরিবেশে মায়া ফিরে গেলে ওর মনের উপর চাপ পরবে আবার কিছু করে বসবে"।

আমি বাড়িতে এসে শ্বাশুড়ীমাকে সবটুকু বলি আর জানতে চাই ," মা ! আমার খুব জানতে ইচ্ছে হয়  এই পণ প্রথা কবে বন্ধ হবে" । "সারাজীবন দুটো মানুষ একসঙ্গে থাকবে সুখে,দুঃখে সেখানে অর্থ কেন প্রাধান্য পাবে। অর্থের বিনিময়ে সম্পর্ক তৈরী হলে সেই সম্পর্ক কি খুব সম্মানের হয়"। শ্বাশুড়ীমা বললেন "বৌমা পণপ্রথা উঠার এখনও অনেকদেরী আছে। আমাদের এখন চিন্তা করতে হবে মায়ার কথা গ্রামে গঞ্জে এখনও লগ্ন ভ্রষ্টা মেয়েকে নানা গঞ্জনা শুনতে হয়।পরবর্তীতে ওর বিয়ে দিতে খুব ঝামেলা পোহাতে হবে ওর মাকে"। ওদের তো পয়সারও জোর নেই সেইরকম । আমি বললাম "মা আমরা কি কোনভাবে সাহায্য করতে পারি না ওদের" ।

শ্বাশুড়ীমা বললেন "আমাদেরই কিছু করতে হবে বৌমা তুমি এখন বেশি রাত হয়নি একবার গনেশকে রমেশের ওখানে পাঠাও যেন কাল সকালে চলে আসে খুব দরকার" । আমি গনেশদাদাকে রমেশ ঠাকুরপোর কাছে পাঠিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম "মা রমেশ ঠাকুরপোকে কেন দরকার আপনার" । শ্বাশুড়ীমা বললেন গত সপ্তাহে দাদার চিঠিতে লিখেছেন "পারিস যদি আমার বাউন্ডুলে ছেলেটা রমেশের একটা বিয়ের ব্যবস্থা করিস ,ওতো আমাদের কথা শোনেনা বয়েস তো হয়েছে এবার বিয়ের তো দরকার  "।"তাই ভাবছি রমেশকে রাজি করাতে পারলে মায়ার সাথে ওর বিয়ের ব্যবস্থা পাকা করি। ওদের তুমি কাল আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসো বৌমা" । 

জানো সকালবেলা হাসপাতালে বেরোবার আগেই দেখি  রমেশ ঠাকুরপো চলে এসেছেন আর মায়ের সঙ্গে কথা বলছেন । আমি কিছু না বলে চুপ করে বসলাম ওনাদের মাঝখানে  । তুমি  তো জানো আমাদের রমেশ ঠাকুরপো ভীষণ উদার মন মায়ার  গল্প শুনে উনি রাজি হলেন মায়াকে বিয়ে করতে। আমি  ভীষণ ভাললাগা নিয়ে  হাসপাতালে গিয়ে দরকারি সব কাজ কর্ম সেরে মায়াকে আর ওর মাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলাম । মায়ার মা রমেশ ঠাকুরপো মতো ছেলে মায়াকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন এই রকম কথা ওনি ভাবতেই পারছেন না । আমি বললাম "আমরা রমেশ ঠাকুরপোর জন্য একটি মেয়ের সন্ধানে ছিলাম , আপনি কিছু ভাবেন না মায়া যোগ্য সহধর্মিনী হবে রমেশ ঠাকুরপোর"। তবুও সৌজন্যের খাতিরে মায়াকে দেখানো হয় রমেশ ঠাকুরপোকে। রমেশ ঠাকুরপোর মায়াকে দেখে পছন্দও হয় এবং মাকে বলেন "বিয়ের ব্যবস্থা করতে" । মা মায়ার মায়ের কাছে কটা দিন চেয়ে নেয় রমেশ ঠাকুরপোর বাবা,মাকে( মামা,মামীমা) জানানোর জন্য । আগামী মাসের পনের তারিখে মা মোটামুটি দিন ঠিক করেছে এইজন্য সেইসময় তুমিও উপস্থিত থাকতে পারবে রমেশ ঠাকুরপোর বিয়েতে যেটা রমেশ ঠাকুরপো বারবার চাইছিলেন ।

** অলোকা চক্রবর্তী **                 **চলবে **



Comments

Popular posts from this blog

আমার স্বপ্নের ঘর

মল্লিকাঅর্জুন ( চতুর্থ পর্ব)

আমি সেই মেয়েটা