যে পাপের কোন ক্ষমা হয়না

**যে পাপের কোন ক্ষমা হয়না **
** অলোকা চক্রবর্তী ** 

আজকে মা তোমার কথা মনে হচ্ছে, আমি মা তোমার সেই মেয়ে যার কথায় কথায় অভিমান হতো। অভিমানে অন্ধ আমি তোমাদের থেকে পালিয়ে নিজের ঘরে নিজেকে  বন্দী করতাম, চোখের জলে ভাসিয়ে বালিশে মুখ গুজে থাকতাম ।কখনও তুমি, কখনও বাবা, কখনও দাদা ,দিদি সবকাজ ফেলে তোমরা  আসতে আমার কাছে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে  বলতে কি ছেলেমানুষি তোর এমন করে মন খারাপ করতে আছে সামান্য কথায়। তোমাদের আদরে ,তোমাদের স্নেহে মূহুর্তে মধ্যে আমার অভিমান কমে যেত। দাদা বলত তোর দোষ না ,তুই সবার ছোট বলে আমরা সবাই মিলে তোকে  আদর ,স্নেহ এতো বেশী করি তাই তুই আমাদের দুর্বলতা গুলো বুঝে গেছিস।

মা আমি সেই   নন্দিতা বাড়ির সবার আদরের নন্দা । আমার দুই বোন, দুই ভাইয়ের সবার ছোট ছিলাম বলে কোন কিছু  চাইতে হতো না, কোন কষ্ট আমাকে ছোঁয়নি কোনদিন  । মফস্বলের ছোট শহরে মানুষ আমরা তবুও বাড়িতে শিক্ষার পরিবেশে তোমরা দিয়েছিলে ।লেখাপড়ায় মোটামুটি ভালো ছিলাম । যতদিন নিজের পথ নিজে না বেছে নিয়েছি ততদিন জীবন ছিল বেশ সুন্দর আমার । স্বাধীনতা ছিল নিজের মতো করে বাঁচার তাই গান করেছি ,বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করেছি ,ইচ্ছে হলে রাত জেগে গল্পের বই পড়েছি ।আমার মধ্যে অবাধ্যতা ছিল না  সংসারে সব নিয়ম মানতাম।গুরুজনদের সম্ভ্রম করতাম।

 দিদিদের বিয়ে  হয়ে যাবার পর থেকেই বিয়ের সমন্ধ আসতে শুরু করে আমি তখন অঞ্জনের প্রেমে অন্ধ তোমাদের কাউকে জানতে দিইনি । বড়দা চাকরি নিয়ে বাইরে চলে গেল আমি দেখেছি তোমার লুকিয়ে চোখের জল ফেলা । তোমাকে বোঝাতাম বলতাম ছেলে বড় হলে মায়ের আঁচলে বেঁধে রাখতে হয় না।আমারও কষ্ট হতো বড়দার জন্য  কিন্তু তোমার সামনে বলতাম না। বড়দি ওর শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়র সঙ্গে  বিয়ের সমন্ধ নিয়ে এলো ।বিয়ে প্রায়ই ঠিক  কিন্তু আমি তো বিয়ে করবো না ।

সেই আমি ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে অঞ্জনকে গিয়ে বললাম চলো আজকে বিয়ে করি ।অঞ্জন বলল বিয়ে কি ছেলেখেলা যে হঠাৎ করে বিয়ে করে নেবো।আমি চাকরি করিনা টিউশনি কয়েকটি ভরসা, কোথায় তোমাকে রাখবো, কি খাওয়াবো আমি তোমাকে ।আমি বললাম আপাততঃ দুজনে মিলে টিউশনি করে চালিয়ে নেবো।অঞ্জন বলল তা হয় না । আমি বললাম তাহলে আমি আমার বাড়ির দেখা ছেলেকে বিয়ে করছি ।জানো মা সেদিন অঞ্জন আমার হাত ধরে কেঁদে ফেলল বলল নন্দিতা তোমাকে ছাড়া আমি  বাঁচতে পারবো না ।
অঞ্জন পড়াশোনায়  খুব ভালো ছেলে,গানের গলাও খুব সুন্দর । কিন্তু আমার মানুষ চেনা মা ভুল ছিল। অঞ্জন যখন সেদিন  আমার কাছে কাকুতি মিনতি করছে বন্ধুরা সেইসময় এসে আমাদের কথা শুনে বলল তোদের চল আজই বিয়ে হবে । স্বপন বলল আমার দিদিদের ফ্ল্যাটে তো আমি থাকি ,দিদিরা এখন বেশ কিছুদিন আসবে না ।তোরা বিয়ের পর ওখানে থাক অঞ্জন চাকরি পেলে তোরা নিজেদের মতো ব্যবস্থা করে নিবি।

মা আমি প্রেমে এতো অন্ধ তোমরা কত কষ্ট পাবে একবারও চিন্তা করিনি ।শুধু বন্ধুর হাত দিয়ে তোমাকে একটা চিঠি পাঠিয়ে ছিলাম আমি বিয়ে করেছি অঞ্জনকে ।স্বার্থপরতা আমাকে গ্রাস করেছিল ভালবাসার জন্য । জানো মা বিয়ের পর কয়েকটি মাস বেশ ভালো ছিলাম ।আমি মাস্টার্স ডিগ্রি খুব ভালো ভাবে পাশ করলাম । আমি একটা কোচিং সেন্টারে পড়াতাম আর অঞ্জন টিউশনি করত ।চলে যাচ্ছিল মোটামুটি তবে আমার মনে শান্তি ছিল না তোমাদের কষ্ট দেওয়ার জন্য খুব অপরাধ বোধ হতো মনে ।

একদিন অঞ্জন বলল তোমার সবকিছু গুছিয়ে নিও  আমরা কালকে ভোরে গ্রামের বাড়ীতে যাবো মা,বাবা মেনে নিয়েছেন আমাদের বিয়ে ।তোমাকে ওনারা দেখতে চান । আমার কোন সন্দেহ হলো না বরং শ্বশুরবাড়ির স্বীকৃতি পাবো বলে আনন্দে পরেরদিন গেলাম । যাওয়ার পর শ্বাশুড়ীমা বরণ করে ঘরে তুললেন,আমার খুব ভালো লাগল ।অঞ্জন বাড়ি বাঁকুড়ার গ্রামে জানতাম কিন্তু এখানে এসে আমার ধ্যান ধারণা পাল্টে গেল ।এদের মধ্যে ভীষণ ভাবে গ্রামীণ সংস্কার, গ্রামীণ কালচার, খাওয়া, দাওয়া সব আলাদা । আমার মানিয়ে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল ।কিছু খেতে পারছিলাম না । অঞ্জনের কাছে কোন অভিযোগ করিনি ভেবেছিলাম কয়েকটি দিন একটু মানিয়ে নিই। কিন্তু অঞ্জন দুদিন পর বলল আমার একটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে বোম্বে যেতে হবে কয়েকদিন থাকতে হবে তুমি সেইকদিন এইখানেই থাকো।আমার মনটা বিদ্রোহ করে উঠল বললাম আগে তো বলোনি ,আর আমি এখানে থাকবো না  আমি ফ্ল্যাটে ফিরবো । অঞ্জন বলল ওখানে স্বপনের দিদিরা এসে গেছে তুমি কোথায় থাকবে । তখন মা আমার কি নিরুপায় অবস্থা । তোমাদের যে জানাবো সে রাস্তা তো আমি নিজেই বন্ধ করেছি। অঞ্জন চলে গেল আমাকে ফেলে ।

অঞ্জন বলে গেছিল কয়েকটিদিন  কিন্তু কয়েক সপ্তাহ হয়ে গেল এলো না । আমার খুব  শরীর খারাপ, শরীরে অন্য লক্ষণ দেখা দিয়েছে ।ফোন করলে ভালো করে কথা  বলে না । খুব যখন রাগ করি তখন বলে  কদিনের মধ্যে আসছি। শ্বাশুড়িমা আমাকে গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার আমাকে দেখে বলে আমি সন্তানের মা হতে চলেছি। আমার এই খবর শুনে আনন্দ থেকে অনিশ্চয়তা বেশি হচ্ছিল  ।অঞ্জনকে ফোনে কয়েকদিন পাচ্ছি না সুইচ অফ বলছে ।দিশেহারা আমি কোথায় যাবো কি করবো কিছু ভেবে পাচ্ছি না ।শ্বাশুড়বাড়ির লোকজনের ব্যবহার খারাপ হতে লাগল এটাই তো স্বাভাবিক যেখানে ছেলে যোগাযোগ করে না তখন অন্যের মেয়ের ওনারা কেন দায়িত্ব নেবেন ।

অঞ্জনের খোঁজ জানবার জন্যে স্বপনকে ফোন করলাম । স্বপন বলল কেন তুই জানিস না অঞ্জন বিদেশে চলে গেছে । স্কলারশিপ পেয়েছে খুব ভালো কলেজে, তোকে এতো আনন্দের খবর জানাইনি আশ্চর্য তো । আমি তখন স্বপনকে আমার অসহায় অবস্থার কথা সব জানলাম,,বললাম আমি এখানে থাকলে বেশি দিন বাঁচবো না ।এখানে এখনও পুকুরে চান করা রেওয়াজ, মাথায় ঘোমটা দিয়ে থাকতে হবে সবসময়, খিদে পেলেও খাবার উপায় নেই বাড়ির পুরুষ মানুষেদের খাওয়া না হলে মেয়েদের খাওয়ার নিয়ম নেই । স্বপনের বান্ধবী আমাদের সঙ্গে পড়ত রমলা সেইসময় স্বপনের পাশে ছিল ও বলল তুই গ্রামের ঠিকানা বল আমি সব বললাম ।ও বলল কালকে ভোরবেলায় আমরা গ্রামের বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবো গাড়ি নিয়ে ।তুই চুপচাপ চলে আসবি আমাদের সঙ্গে ।আমি বললাম আমি থাকবো কোথায়? রমলা বলল  আমার মেসে থাকবি যেখানে আমি থাকি ।আমার ঘর ফাঁকা আছে। আমি বললাম ঠিক আছে  তোরা আয়।

আমি জামাকাপড় সবগুছিয়ে নিয়ে  একটা চিঠি লিখে রেখে ভোর রাতে চুপচাপ বেরিয়ে এসে বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার কিছুক্ষণ পর ওরা এলে গাড়িতে উঠে চলে এলাম । স্বপন বলল তোর সাথে অঞ্জন এমন ব্যবহার করবে ভাবতে পারিনি।এইরকম ভালবাসার মানে কি যার কাছে সত্যি কথা বলা যায় না ।
তোকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারত তুই তো অশিক্ষিত না। আমরা জোর করে বিয়ে দিয়েছি তোদের আজকে খুব খারাপ লাগছে । রমলা বলল মানুষকে চেনা খুব মুশকিল ।নন্দিতা আর  অঞ্জনের এতোদিনের সম্পর্ককে অঞ্জন এইভাবে মূল্যহীন করবে ভাবা যায় না । রমলা বলল আমাদের স্কুলে একটা পোস্ট খালি আছে সেখানে আমি দেখছি তোকে নেওয়া যায় কিনা ।

মা আমি রমলা আর স্বপনের সাহায্য স্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ পেলাম । তারপর কয়েকমাস পর আমার মেয়ে হলো ।বন্ধুরা খুব সহযোগিতা করল মেয়ের আগমনের সময় । স্কুলের এক শিক্ষিকা একজন মহিলাকে দিলেন মনাদিকে ।মনাদি খুব ভালো মানুষ  আমার মেয়েকে আগলে রাখেন ।আমি একটা ভাড়া বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে উঠে এসেছি  মা।
আজকে মেয়ের পাঁচ বছর বয়েস। মা আমার মেয়ে ওর বাবাকে খোঁজে, সবার বাবা আছে ওর বাবা কোথায় ।মা আমি কি করে বলি ওর বাবা একটা প্রতারক ।

মা  স্বপন আর রমলা বিয়ে করেছে ওরা আমার মেয়েকে খুব ভালবাসে ।মেয়ে স্বপনকে মামা বলে ,মামার খুব ভক্ত ।স্বপন চেষ্টা করে ওর বাবার অভাবটা পূরণ করতে । মা আমি আজ ছবছর তোমাদের দেখিনি । জানো মা এখন আর আমার অভিমান হয় না ।কার কাছে অভিমান করবো মা!, সেই স্নেহের পরশগুলোর আজকে খুব অভাব বোধ করি ।কত রাত কেঁদে জেগে কাটাই, আমার ভুল আমার সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে । মাগো আজকাল খুব ইচ্ছে করে তোমার কোলে মাথা রেখে একটু শান্তির ঘুম ঘুমাই। জানি না  মা অঞ্জন বিদেশে কত সুখে আছে  যে ওকে এতো বড় প্রতারণার আশ্রয় নিতে হলো। ভালবাসার অন্ধ আমি  অঞ্জনের জন্য তোমাদের ছেড়ে চলে এসেছিলাম পিছন ফিরে না তাকিয়ে ।এখন ভগবানের কাছে একটাই প্রার্থনা একবার যেন তোমাদের দেখতে পাই । জানো না মা তোমার আদরে নন্দা কি জঘন্য পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছে দেখলে তোমরা সহ্য করতে পারবে না ।

জানো মা আমি যখন মা হলাম তখন সবার আগে তোমার মুখটা মনে পরেছিল ।মনে হয়েছিল আমার মা কত হাসি মুখে আমার সব আবদার সহ্য করত । জানো মা বন্ধুরা  আমার শরীরে যখন প্রথম অনাগত অতিথির আগমনের কথা জেনেছিল ওরা নষ্ট করে দিয়ে আমাকে আবার স্বাধীন ভাবে জীবন কাটাতে বলেছিল ।আমি নিষ্পাপ শিশুর আসাকে বন্ধ করতে চাইনি  ।আর তাছাড়া  আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছিলাম মা হয়ে। এক মাকে কত কষ্ট দিয়েছি নিজে মা হয়ে আজ মর্মেমর্মে বুঝতে পারছি ।মা তোমার নন্দা ভালো নেই মা।




 

Comments

Popular posts from this blog

আমার স্বপ্নের ঘর

মল্লিকাঅর্জুন ( চতুর্থ পর্ব)

আমি সেই মেয়েটা