দাদার জিজ্ঞাসা (প্রথম পর্ব )
** দাদার জিজ্ঞাসা **
বোন আজকে তোদের মস্ত গেট ওয়ালা বাড়ির সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে এলাম, তোকে ভীষন দেখতে ইচ্ছে করছিল তাই একটা রাখী আর তোর জন্য টিউশনির টাকা বাঁচিয়ে একটা কাপড় কিনে গেছিলাম। ইচ্ছে ছিল প্রত্যেক বারের মতো এবারও রাখিটা হাতে বেঁধে তুই বলবি আমার দাদা সববিপদ মুক্ত হোক আর সব খুশি দাদার ঝুলি ভর্তি হোক। তারপর প্রনাম করেই হাতটা পেতে বলবি দাদা ! ফাঁকি দেওয়া চলবে না ।
কিন্তু বোন তুই যে আমার আদরের বোন থেকে এখন বড়লোক বাড়ির বউ হয়ে গেছিস। তাই হয়তো তুই ধরা ছোঁয়ার বাইরে আমার যা কল্পনাতীত । ভাবতে পারিনা তোর সঙ্গে আমার এতো দূরত্ব তৈরি হবে কোন যোগাযোগ থাকবে না । তোর কাছে পৌঁছাতে পারলাম না শুধু আমি গরিব বলে আচ্ছা তোরও কি একবারও মনে পরে না আমাদের কথা।
তোদের দারোয়ান আমার পোশাক দেখে বিশ্বাসই করলো না আমি তোর দাদা যে নিঃস্ব হয়েছি তোর সুখের জন্য।কত অনুরোধ,কত অনুনয় করলাম তোকে একটু খবর দিতে । খবর দেওয়া তো দূর অস্ত আমাকে মানুষের সম্মানও দিলনা বোন ।
দাঁড়িয়ে থাকলাম এই আশায় যদি তুই জানালার ঝুলানো দামী পর্দা সরিয়ে একবার উঁকি দিস কিম্বা তোদের ওই চওড়া বারান্দায় একবার এসে দাঁড়াস। ওখান থেকে আমাকে দেখলে তুই ঠিক ছুটে আসতিস সব বাধা অতিক্রম করে আমি জানি বোন সেইজন্য কতক্ষণ অপেক্ষা করেছি নিজেই মনে করতে পারছি না।
জানিস বাবা যাবার সময় তোর হাতটা আমাকে দিয়ে বলেছিলেন ওকে দেখে রাখিস ,আমার অবর্তমানে তুই ওকে বাবার মতো সামলে রাখিস সব ঝড় ঝঞ্ঝা থেকে ।লেখাপড়া যেন তোর মতো করে। সেই থেকে সব নিজের সুখ ভুলে তোকে আর মাকে নিয়ে তোদের সুখী রাখার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল আমার।
জানিস মা যেন কেমন করে আজ টের পেয়েছিল আমি তোর কাছে যাবো সেইজন্য বাড়ি ফিরতেই নানারকমের প্রশ্ন, তুই কেমন আছিস? কেমন দেখতে হয়েছিস। বড়লোক বাড়িতে আমাকে কেমন আপ্যায়ন করলো , নিশ্চয়ই অনেককিছু খাইয়েছে কিন্তু বোন খিদেতে পেট জ্বলে যাচ্ছে তবুও মাকে সত্যি টা বলতে পারিনি। অনেকদিন পর মায়ের মুখটা খুশিতে ভরা দেখেছিলাম আমি ।হয়তো মা চোখে পরিস্কার দেখতে পেলে ধরে ফেলতো আমার মুখ দেখে। আমি যে একটু তোকে দেখার জন্য অনেক আশা নিয়ে গেছিলাম বোন।
জানিস বোন মায়ের চোখ অপারেশন করিয়েছিলাম কিন্তু লাভ হয়নি মায়ের দৃষ্টি শক্তি আরও কমে গেছে।
আমাদের এই শরিকি বাড়ির একতলার অন্ধকার ঘরে মা থাকতে থাকতে কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেছে । আলো বাতাস সব আমাদের একচিলতে উঠনেই থমকে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের ঘরগুলো ওদের কাছে অবাঞ্ছিত ।
তোর বিয়ের কয়েকদিন আগে যখন তোর শ্বাশুড়ীমা গয়নায় ভালোভাবে সাজিয়ে দিতে বলল তাদের পরিবারের ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য আর প্রণামীর ফর্দে কার জন্য কোন শাড়িটা কিনতে হবে পরপর শাড়ি নাম আর লিষ্ট দেখে আমি দিশেহারা হয়ে পরেছিলাম তাই বাধ্য হয়ে প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন নিয়ে ছিলাম । এখন তাই মাইনের বেশিটুকু কেটে নেয়,তবু ওই দুবেলা টিউশনিতে আমাদের মা,ছেলে আর বিন্দু দিদিকে নিয়ে কোন রকমে কেটে যায় ।বিন্দু দিদি সারাদিন মাকে দেখাশোনা করে,আমাদের খাবারের ব্যবস্থাও করে। আমাদের অসহায় অবস্থা দেখে যখন আমাদের আত্মীয়রা একে একে আমাদের ছেড়ে চলে গেল তখন বিন্দুদিদি আমাদের পরমাত্মীয় হয়ে সংসারে হাল ধরেছে নইলে অকূল জলে পরতাম।
যাক তোকে যেটা বলা হয়নি কয়েকমাস আগে মিতার বিয়ে হয়ে গেছে । তোর বিয়ের আগে মিতার সঙ্গে একটু মনোমালিন্য হয়ে ছিল । মিতা বলেছিল এতো ধার দেনা করে এই বিয়ে দেবার কি দরকার ছিল আর কি ভালো ছেলে পাওয়া যেত না । আমি ওকে বুঝিয়ে বলেছিলাম আমার বোন আর ছেলেটার ভালবাসার সম্পর্ক সেই কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি অবধি ।ওরা দুজনে খুব ভালবাসে পরস্পরকে। মিতা বলেছিল যে ছেলে ভালো চাকরি করে সে বউকে কয়েকটি গয়না কিনে দিতে পারবেনা?, একটা মেরুদণ্ড হীন ছেলে যৌতুকের জন্য মায়ের কথার প্রতিবাদ করেনা সে আবার কি ভালবাসে। এত বছরের সম্পর্ক যখন তখন তোমাদের পারিবারিক অবস্থা নিশ্চয়ই জানে । আমি মিতাকে বুঝিয়েছিলাম তুই আমার বোন হলে আমি তোকে এতদিন বাবার মতো আগলে রেখে মানুষ করেছি তাই তোর সুখের জন্য আমি সব করতে পারি ।
জানিস বোন মিতার কথাগুলো যেমন আমার ভালো লাগেনি তেমনই হয়তো ধারে জর্জরিত একটা মানুষকে ভালবাসার অযোগ্য মনে হয়েছে মিতার । ভেবেছে হয়তো আমি অক্ষম সামান্যতম ওর আশা আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণ করতে পারবো না । আসতে আসতে যোগাযোগ কমিয়ে তারপর বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে জীবনকে নতুনভাবে জানার সুযোগ পেলাম ।আমার মতো মানুষের কাছে কিবা পেত?থাকুক মিতা সুখে ।
অনেক রাত হলো কিন্তু ঘুম আসছে না তোর চিন্তায়, এই প্রথম তুই আমাকে রাখি পরালি না, বললি না দাদা ভালো করে আশীর্বাদ কর আমি দেবতা জানি না শুধু তোকে জানি। এই পৃথিবীর সব থেকে সৌভাগ্যবতী বোন আমি দাদা । কেন বোন তোর আর আমাদের মধ্যে প্রাচুর্য আর আভিজাত্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়াল। তোর দাদা ঘন্টা পর ঘন্টা প্রতীক্ষা করে তোকে একটু দেখতে পেল না । স্কুল থেকে টিউশন করে কোনদিন ফিরতে দেরি হলে কলিং বেলের আওয়াজ করলেই তুই ছুটে এসে জড়িয়ে বলতিস দাদা কেন দাদা এতক্ষণ তোকে ছাড়া আমার ভালো লাগে না । আমি দূর পাগলী কদিন পর যখন শ্বশুরবাড়ি যাবি তখন কি করবি। তুই বলতিস ছেড়ে দে দাদা ওসব বিয়ের ঝামেলা আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না । অথচ আজ একবছর তোর বিয়ে হয়ে তুই চলে গেছিস একবারও এই দাদাকে জড়িয়ে বললি না দাদা কেমন আছিস ।
Comments
Post a Comment